মোহাম্মদ জাফরুল হাসানঃঃ বর্তমান বাংলাদেশের মানবেতর পরিস্থিতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় যত না ঘটছে তা ছাপিয়ে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে সবাইকে হতবাক করছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচাইতে আলোচিত, সমালোচিত, ঘৃণিত কিংবা ন্যক্কারজনক বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘রাজনীতি’। ‘ঘৃণিত’ বা ‘ন্যক্কারজনক’ এ কারণেই বলছি, রাজনীতি কথাটা শুনলেই এখন আর ‘রাজার নীতি’ ‘নীতির রাজা’ কিংবা জনগণের জন্য কল্যাণকর বিধিবিধানের কথা মনে হয় না। মনে হয়, নোংরা-পচা নর্দমার মতোই দুর্গন্ধযুক্ত কোনো বিষয়। যে রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সকল নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা এবং বিরোধী মতকে দমনের প্রচেষ্টা করা। আর এটাই এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যে রাজনীতি মানুষের শ্রদ্ধা এবং আস্থা অর্জনে ব্যর্থ। বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই লাশের রাজনীতি, হত্যা, খুন, গুম, দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের রাজনীতি। কেননা, এই রাজনীতি প্রতি মুহূর্তে এমন অসংখ্য নৃশংসতা আমাদের উপহার দিয়ে চলেছে।
যে জাতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য থেকে স্বাধীন হয়েছে, পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছে, সেই জাতিই আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের কাছেই পরাজিত হচ্ছে। বহির্দেশীয় পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি পেলেও রোমান গ্লা-ডিয়েটরের মতো বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক পরাধীনতার শেকলে বন্দী। প্রতিটা মুহূর্তেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমগ্ন এদেশ। খুন, হত্যা, গুম, গ্রেফতার, রিমান্ড, আহত-নিহত এমন হাজারও দুঃসংবাদ আর দুর্ঘটনায় দেশে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি, অন্যদিকে, সর্বদলীয় সরকারে অনড় থাকা নিয়ে দেশে চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এবং বিরোধীদলগুলোর ভেতরকার মারমুখী এই দা-কুমড়ো সম্পর্কের জের ধরে বিরাট রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যা কিনা দেশবাসীকে চরমভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। এমন কোনো দিন পার হচ্ছে না, যেদিন এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরে মানুষের মৃত্যু ঘটছে না। চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, সীতাকুণ্ড, সিলেট, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, যশোরসহ বাংলাদেশের প্রতিটি শহর-বন্দরে, জেলায়, থানায় মৃত্যুর সংবাদ যেন একটা দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছে। পুলিশ বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নির্দ্বিধায় জনগণের বুকে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে যা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। এত নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, নৃশংসতা, হিংস্রতা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। অবস্থা বিশেষে মনে হয়, রাস্তার একটা কুকুরের চাইতেও এখন এদেশে মানুষের জীবনের মূল্য কম। কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই পথে, ঘাটে, মিছিল, মিটিং, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এমনকি নিজের বাড়িতেও জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেয়াল-কুকুরের মৃতদেহের মতো দেশের আনাচে কানাচে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকে। এই লাশ নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি, আবারও জমে লাশের স্তূপ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বর্তমান এই রূপ এবং এর ফলাফল পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সংকটাবস্থায় বিশ্ব রাজনীতিও এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। নিউইয়র্ক টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটসসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও সংস্থা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, পরামর্শ প্রদান করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বের চলমান রাজনৈতিক সংকট-সংঘাতময় দেশের তালিকায় বাংলাদেশও আজ বিশেষভাবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া ‘দেশ এখন গৃহযুদ্ধের দিকে, বাংলাদেশ এখন যুদ্ধক্ষেত্র, দেশে সামরিক শাসন আসন্ন, দেশের গণতন্ত্র আজ সংকটময়, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার চলমান, কোথায় চলেছে দেশ, দেশে জরুরী অবস্থা জারির পাঁয়তারা, রাজনৈতিক ক্যান্সারে আক্রান্ত দেশ!!
লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, ফ্রান্স দর্পণ