শাহ আলম রাজন ; বর্তমান সমাজে যখন প্রেম, স্বাধীনতা এবং মানবিক অনুভূতির কথা আসে, তখন অনেক সময় নানা সামাজিক ও ধর্মীয় শর্তাবলী তাদের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে। সম্প্রতি সিলাম রিজেন্ট পার্কে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক বিবাহ দেয়ার যে প্রক্রিয়া এবং এর সাথে যুক্ত অপমানজনক দৃষ্টিভঙ্গি সেটি একটি বড় ধরনের সমাজের দ্বৈত মানসিকতার প্রকাশ। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, যা গভীর চিন্তার দাবি রাখে।
প্রথমত, যদি কোন মানুষ বা যুবক-যুবতী নিজের সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তা তাদের যৌবনের স্বাভাবিক প্রবণতা হয়, তাহলে সেটি তাদের ব্যক্তিগত অধিকার। সুতরাং, প্রেমের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করা, একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া, এটি কোন অপরাধ নয়, বরং মানবিক এবং প্রাকৃতিক অনুভূতি। যখন সমাজ বা ধর্মের নামে এই সম্পর্কগুলিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়, তখন তা মূলত মানবিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ। যে সমাজ ভালোবাসা এবং সম্পর্ককে নিপীড়ন বা আক্রমণ করে, সেটি মানবাধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করে।
দ্বিতীয়ত, আমরা যখন দেখি যে যুবক-যুবতীদের প্রেম এবং সম্পর্ককে সমাজ রক্ষার নামে দমন করার চেষ্টা হচ্ছে, তখন এটি সমাজের দুটি বিপরীতধর্মী মানসিকতার প্রকাশ। একদিকে, তারা ভালোবাসার প্রকাশ এবং যৌবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে অবৈধ বা অপরাধ হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে তারা নিজেদের শর্তে, সমাজ বা ধর্মের নামে একই অনুভূতি বা সম্পর্ককে চুপিসারে অগ্রাহ্য করছে। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি দ্বৈত মানসিকতা, যেখানে একদিকে ধর্ম বা সমাজের ধারণা অনুযায়ী তাদের ‘সঠিক’ পথ প্রদর্শন করা হচ্ছে, অন্যদিকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী এমন আচরণকে সহজে গ্রহণ করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত, পার্কের মতো জনসাধারণের স্থান যেখানে সবাই একসাথে সমবেত হয়, সেখানে অবাধে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে বা অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া একান্তভাবে স্বাভাবিক। যারা বলেন যে, “এখানে গরম হয়ে আসা এবং পরবর্তীতে নরম হয়ে যাওয়া,” তাদের বক্তব্যের মধ্যে মজার দিকটি হলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গির অভ্যন্তরীণ বিভাজন। এসব বক্তব্যে তারা আসলে সমাজের কিছু প্রতিষ্ঠিত সংস্কার এবং লুকানো দ্বৈত মানসিকতার কথা তুলে ধরছেন। তাদের বক্তব্যের মধ্যে একটি দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে যে, প্রশাসন এবং পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা প্রদান করে যেন সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়, কিন্তু যখন নিজের বা বিশেষ ঘোষ্টির প্রয়োজন আসে তখন কোন নীতির প্রয়োজন হয়না।
এটি একটি সুবিধাবাদী মনোভাব।
এছাড়া, “মুক্ত ভালোবাসা” বা “স্বাধীন সম্পর্কের” ধারণা একটি সভ্য সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দিক। কোনো অবস্থাতেই সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নীতি বা নিয়ম এমনভাবে মানুষের সম্পর্ক বা ভালোবাসাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। তবে যদি পার্ক বা এমন কোন জায়গায়, যেখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার রয়েছে, সেখানে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া বা স্বাধীনতা উপভোগ করা যায়, তবে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা, যা একটি সভ্য এবং মুক্ত সমাজের পরিচায়ক। যে কোনো ধরনের পীড়ন বা বাধা সেই সমাজের আত্মবিশ্বাস এবং শৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে।
*এটি স্পষ্ট যে, ভালোবাসা এবং স্বাধীনতা আমাদের মৌলিক অধিকার। কোনো সামাজিক অথবা ধর্মীয় আদর্শের নামে এই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া সমাজের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। তাই আমাদের উচিত এই ধরনের নিপীড়ন, বিভাজন এবং সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে একজন মানুষের ভালোবাসা, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত অধিকারকে সম্মান জানানো।*
লেখক : লন্ডন প্রবাসী ,সাবেক প্রভাষক