ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার সিদ্ধান্তকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান সমর্থকরা স্বাগত জানালেও তা নিয়ে নাখোশ ডেমোক্র্যাটরা। তাদের আশঙ্কা, এ সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা বিভাজিত হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা সিদ্ধান্তটি যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরাও। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ঘটবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক উত্তেজনা তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা জানিয়েছেন তারা।
২০১৫ সালের জুনে তেহরানের সঙ্গে পরমাণু ইস্যুতে ৬ জাতিগোষ্ঠী চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভিয়েনায় নিরাপত্তা পরিষদের ৫ সদস্য রাষ্ট্র (পি-ফাইভ) যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি (ওয়ান) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা। বুধবার পূর্বসূরী ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে ‘ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল’ আখ্যা দিয়ে তা থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াশিংটনে রিপাবলিকান সমর্থকরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত নিয়ে কংগ্রেসে তাদের দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। জেসিপিওএ তথা জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনকে ‘বাজে চুক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা। তবে ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ডেমোক্র্যাট শিবির। তাদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের এ পদক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা বিভাজিত হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্র্যাট চাক শুমার ক্যাপিটল হিলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের উচিত চুক্তিটি বহাল রাখা।’ তিনি আরও বলেন, ‘একতরফা নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কাজ করবে না এবং আমি জানিনা এরপর আসলে আমাদের মিত্ররা কী করবে।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে অসেন্তাষ জানিয়েছেন তিনিও। ওবামা ইরানের পরমাণু সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার ঘোষণাকে ভুল বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একটি দেশের প্রশাসন পরিবর্তন হলে তার নীতিতে পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে কমে যাবে।’
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ান জানায়, যেসব দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। ইরানের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া যেকোনও বিদেশি কোম্পানির ওপর অবরোধ পুনঃআরোপের জন্য একটি নির্বাহী আদেশেও স্বাক্ষর করেছেন তিনি। ওই আদেশের আওতায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ৯০ দিন থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তাদেরকে ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে।
পরমাণ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার মধ্য দিয়ে দুটি দৃশ্যপট উদ্ভূত হবে বলে মনে করছেন পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা। এর একটি হলো, চুক্তিটি টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার চাপ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেই ইউরোপ, চীন এবং রাশিয়া ইরানের সঙ্গে কাজ করতে পারে। আর তা নাহলে বিশেষজ্ঞরা যে বিকল্প পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন তাহলো-‘ইরানের নেতৃত্ব এ চুক্তির সঙ্গে থাকতে পারবে না এবং আবারও পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করবে।’ আর সব মিলে বাজে পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী সংগঠন প্লাউশেয়ারস ফান্ডের নীতিমালাবিষয়ক পরিচালক টম জেড কোলিনা আল জাজিরাকে বলেন, ‘কিছু দিক থেকে বলতে পারি, ঘড়ির কাঁটা এখন টিক টিক করছে। কতক্ষণ পর্যন্ত ইরানের সংস্কারপন্থীরা স্থির থাকবেন এবং চুক্তিটি কার্যকর করবেন? যদি শেষ পর্যন্ত তারা তা না পারে, তবে আপনারা সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি দেখতে পাবেন। দেখবেন, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড নতুন করে শুরু করেছে।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক নির্দলীয় সংগঠন আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ড্যারিল কিমবাল মনে করেন, চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের এমন আচরণের পর আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় ইরানের সম্মতি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এবং নবনিয়োগকৃত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যেসব কল্পনাপ্রসূত কথা বলেন, তাই বিশ্বাস করেন ট্রাম্প। তারা ট্রাম্পকে বোঝাচ্ছেন যে, নিষেধাজ্ঞা পুনঃআরোপের চেষ্টার মধ্য দিয়ে ইরানিদের সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে ইউরোপীয়দেরকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করা যাবে। আর তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো হবে এবং ইরানিদের জন্য বাজে হবে।’ তবে কিমবাল মনে করেন ‘এটি একেবারেই আজগুবি চিন্তা-ভাবনা।’
সংঘাতের আশঙ্কা করছেন, কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্যেষ্ঠ গবেষক কারিম সাদজাদপোর টুইটারে বলেন: ‘জেসিপিওএ থেকে ট্রাম্পের সরে আসার মধ্য দিয়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একইরকমের ভয়ানক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাহলো: ইরান যুদ্ধ, ইরানি বোমা কিংবা ইরান সরকারের ধসে পড়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিরিয়া ইরাক, আফগানিস্তান, সাইবার, জ্বালানি, নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ এবং পারমাণবিক বিস্তার প্রশ্নে ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের জাতীয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ আছে। সরাসরি সংঘাতের সুযোগ অবারিত।’
তবে ট্রাম্প একা হয়ে পড়েছেন বলে মনে করছেন পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী সংগঠন প্লাউশেয়ারস ফান্ডের নীতিমালাবিষয়ক পরিচালক টম জেড কোলিনা। তিনি বলেন, ‘চুক্তি থেকে সরে না আসার জন্য ট্রাম্পকে বোঝাতে আমাদের সবচেয়ে ভালো ও ঘনিষ্ঠ মিত্ররা ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। তারপরও যেকোনওভাবেই হোক তিনি তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এখন যে একমাত্র মিত্র ট্রাম্পের পাশে আছেন তিনি হলেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।’
ইরানের বৈরি দেশ সৌদি আরব ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ক্ষোভ জানাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ইরানের সঙ্গে চুক্তিকারী বাকি ৫ দেশ চুক্তি বহাল রাখার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বিষয়ে বক্তব্য রাখেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ফেডেরিকা মোগেরিনি। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত এ সমঝোতা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে কার্যকরভাবে বিরত রাখতে পেরেছে। কাজেই ইইউ এ চুক্তিতে অটল থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফ্রান্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তির মৃত্যু হয়নি। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেন ইভস লা দ্রিয়ান বলেছেন, চুক্তিটি বহাল রয়েছে।
/এফইউ/