নজমুল কবিরঃ ফ্রান্স দর্পণ পত্রিকা এখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে একটা জরিপ কেন প্রয়োজন হলো? এর মাধ্যমে আমরা কী পেতে যাচ্ছি, এমন প্রশ্ন আসতে পারে। এর উত্তর আসলে জরীপের প্রশ্নগুচ্ছের ভেতরই আছে!
ফ্রান্সে বাংলাদেশীদের সংখ্যা এখন অর্ধ লক্ষ অতিক্রম করেছে বলে নানা সূত্রে জানা যায়। এর সিংহ ভাগই এসেছেন গত এক দশকে। অর্থাৎ ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ৮০ ভাগ এসেছেন গত ১০ বছরে। ফ্রান্স দর্পণ – বিসিএফের উদ্যোগে চালানো অনলাইন জরীপে এ চিত্র উঠে এসেছে।
এছাড়া জরীপে দেখা যায়, প্যারিস ও ববিনি এলাকায় বাংলাদেশীরা বিভিন্ন সময়ে আরবী ও আফ্রিকান অভিবাসী কর্তৃক শারীরিক হামলা এবং ছিনতাইয়ের শিকার হন। জরীপে অংশ নেয়া ৩৮.৩৫% জন ফরাসী ভাষা শেখার জন্য স্কুলে যায় না।
প্রায় ১০ দিন ব্যাপী ফেসবুক ব্যবহারকারী ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে এই জরীপ চালানো হয়। অবশ্য সরাসরি ফরমেও বেশ কিছু প্রবাসী জরীপে অংশ নেন। এসময়ে জরীপে অংশ নেন প্রায় ৭ শতাধিক ব্যক্তি।
জরীপে অংশ নেয়া প্রবাসীদের কাছে প্রশ্ন ছিল ঃ
১. আপনি কত বছর যাবৎ ফ্রান্সে বসবাস করছেন?
২. আপনি কোন্ ‘প্রিফেকচুর’ (পুলিশ স্টেশন) এর অধীনে বসবাস করেন?
৩. ফ্রান্সে আপনি কোন্ সেক্টরে কাজ করেন?
৪. ফ্রান্সে আপনি গত ১০ বছরে কখনও ছিনতাই বা শারীরিক হামলার শিকার হয়েছেন?
৫. আপনি ফরাসী ভাষা শেখার জন্য কতদিন কোর্সে অংশ নিয়েছেন?
ফ্রান্সে কত বছর ধরে বসবাস করছেন, এমন প্রশ্নে দেখা যায়, গত ১০ বছরেই ৮০% এর বেশি বাংলাদেশী এখানে এসে বসত গেড়েছেন। ব্যাপ্তির হিসেবে বিগত শতাব্দীর শেষদিকে ফ্রান্সে নগন্যসংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসী হয়। জনশ্রুতি আছে, ইংল্যান্ডের পর ইউরোপে ইতালীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশী অভিবাসী হয়। বিগত ১০ বছরকে বিবেচনায় নেয়া হলে তৃতীয় স্থানেই রয়েছে ফ্রান্স।
ফ্রান্সের বা ইল দ্য ফ্রান্সের কোন এলাকায় বসবাস করেন এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তরদাতাদের সবচেয়ে বেশী সেইন সেন্ট ডেনিস বিভাগের কথা বলেছেন। আবার ববিনি (৯৩) প্রিফেকচুর এর অধীনে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশীর বসবাস(৩৯.৯৩%)। দ্বিতীয় স্থানে আছে প্যারিস (৭৫) প্রিফেকচুর। এখানে ২৭.৪৩% বাংলাদেশীর বসবাস। এই ২টি এলাকার মোট হিসেব করে দেখা যায় জরীপে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৬৭.৩৬% বাংলাদেশীর বসবাস রাজধানী প্যারিস ও পার্শ্ববর্তী ববিনি এলাকা। জরীপে অংশগ্রহণকারী ৫৭৬ জন এর মধ্যে অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারীর সংখ্যা যথাক্রমে, সার্সেলে ৪৩ জন, নন্তেয়ারে ৩৯ জন, ক্রিতাইলে ২০ জন।
ভার্সাই, ইভরি, মুলানাই , সেরজি প্রিফেকচুরে বসবাসকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম বলে জরীপে উঠে এসেছে।
ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে জনপ্রিয় কাজের ক্ষেত্র কোনটি? অর্থাৎ কোন্ সেক্টরে বেশীরভাগ বাংলাদেশী কাজ করে এমন প্রশ্নে দেখা যায়, মোট উত্তরদাতার (৩৫৪) মধ্যে ৫২.২৬% বাংলাদেশীর কাজের ক্ষেত্র হলো রেস্টুরেন্ট সেক্টর। উত্তরদাতাদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪.২৯%) কাজ পায়নি বা উপযুক্ত কাজ খুজছেন। বাংলাদেশীদের অন্যান্য কাজের সেক্টর হলো, আবাসিক হোটেল (৫.৬৫%), নিজস্ব ব্যবসা(৬.২১%)। এছাড়া ট্যাক্সিফোন, ফ্যাক্টরী, আলিমন্তাসিওঁ বা মুদি দোকান,খাবার ডেলিভারী, সুপার মার্সি , বুলাঞ্জরি সেক্টরেও নগন্যসংখ্যক বাংলাদেশী কাজ করছে।
হতাশাজনক হলো, এদেশের সরকারী চাকুরের সংখ্যা একেবারেই উল্লেখ করার মত নয়(২% এরও নীচে)।
প্যারিস এবং ইল দো ফ্রান্সে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের অন্যতম সমস্যা হলো, তারা ক্রমবর্ধমান হারে আফ্রিকান ও আরব অভিবাসীদের দ্বারা শারীরিক লাঞ্ছনা এবং ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে। এই প্রশ্নে ৩৪৬ জন অংশ নেয় এবং এর মধ্যে ১২১ জনই বলছে তারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত কিম্বা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় ৩৫% প্রবাসী এই দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন বলে জানান। এর মধ্যে ববিনি এলাকায় সর্বোচ্চ ৭১.০৭% আক্রান্ত হয়েছেন, দ্বিতীয় স্থানে আছে প্যারিস (১৮.১৮%)। এই দুই এলাকা মিলে শারীরিক হামলা এবং ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে প্রায় ৯০%। অন্যান্য এলাকায় এই ঘটনা উল্লেখযোগ্য নয়।
ফ্রান্সে কাজ ও জীবন চালাতে ফরাসি ভাষা শিখার বিকল্প নাই। কিন্তু এই ভাষা শিখতে একজন অভিবাসী বাংলাদেশী কতটা আগ্রহী তা জানতেই মূলতঃ জরীপে এ প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো। এক্ষেত্রে মাত্র ১০৫ জন জরীপে অংশ নেন। এর মধ্যে আবার ৩৮.৩৫% জানান তারা ভাষা শিখতে কোন কোর্সে অংশ নেয়নি। ২৯.৩২% ভাগ মাত্র ১-৩ মাসের কোর্সে অংশ নিয়েছেন। আর ২১.৮০% ৬ মাস থেকে ১ বছর মেয়াদী কোর্সে অংশ নিয়েছেন।