হার্ড কথার অর্থ হল জনগোষ্ঠী। আর ইমিউনিটি হল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সমাজের বেশির ভাগ মানুষের শরীরে যখন কোনও বিশেষ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, হয় টিকা নিয়ে, নয়তো জীবাণু সংক্রমণের মাধ্যমে, আর তার সুবিধে পেতে শুরু করেন বাকিরাও, তাকেই বলে হার্ড ইমিউনিটি।
ধরুন, আপনি টিকা নেননি, সংক্রমণও হয়নি আপনার, কিন্তু আপনার আশপাশে যাঁরা আছেন তাঁরা এই পদ্ধতির মধ্যে কোনও একটার মাধ্যমে ইমিউনড, তা হলে আপনি ইমিউনড না হওয়া সত্ত্বেও আপনার সংক্রমণ হবে না। বা যদি বাইরে অন্য কারও থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসেন, আপনার রোগ হতে পারে, কিন্তু যাঁরা আপনার সঙ্গে ওঠবোস করেন, তাঁদের মধ্যে তা ছড়াতে পারবে না। অর্থাৎ, একের থেকে অন্যের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর শৃঙ্খল ভেঙে যাবে। কমবে রোগের প্রকোপ। ইতি হবে মহামারির। যেমন হয়েছে বসন্ত, হাম, মাম্পস, পোলিও ইত্যাদির ক্ষেত্রে। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ টিকা নিয়েছেন। যাঁরা নেননি, তাঁরাও নিরাপদ রয়েছেন অন্যদের দৌলতে। হার্ড ইমিউনিটির দৌলতে।
এ বার তা হলে প্রশ্ন, করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে কি হবে না। করোনার টিকা এখনও নেই। কাজেই হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে, তাকে আসতে হবে সংক্রমণের পথ ধরেই। সেটা কি ঠিক না ঠিক নয়, সেই প্রসঙ্গে এখন দ্বিধাবিভক্ত চিকিৎসক সমাজ। কেউ মনে করছেন যে কোনও মূল্যে সংক্রমণ ঠেকাতে হবে, না হলে ঘোর বিপদ। কেউ ভাবছেন, টিকা যখন নেই, তা হলে এ ভাবে যদি মানুষ বাঁচতে পারেন, তো বাঁচুন না। এই সব ভাবনার মূলে ইন্ধন জুগিয়েছে সুইডেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইটালি। আসুন সেই চিত্রগুলি এক বার দেখে নেওয়া যাক।
পথপ্রদর্শক সুইডেন
সচেতন ভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার রাস্তায় হেঁটেছে সুইডেন। করোনা ঠেকাতে সারা পৃথিবী যখন লকডাউনের পথ বেছে নিয়েছে, ব্যতিক্রম সুইডেন। অফিস-কাছারি থেকে শুরু করে রেস্তরাঁ, পাব, সিনেমা হল, খোলা রয়েছে সব। কারণ তাঁরা চান, মানুষে মানুষে মেলামেশা হোক। রোগ ছড়াক সুস্থ-সবল-তরতাজা মানুষের মধ্যে। শুধু ঘিরে দিয়েছেন কেয়ার হোমের চারপাশ, অর্থাৎ যেখানে বয়স্ক মানুষেরা থাকেন। বিশেষ সাবধানতা নিয়েছেন রুগ্ণ ও প্রতিরোধক্ষমতা কম এমন মানুষদের জন্য।
শুরু থেকে এক নিয়ম। যার ফলে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা থেমে নেই। ১৯ এপ্রিল, ২০২০-তে সে দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩,৮২২ জন, মারা গিয়েছেন ১.৫১১ জন। ৮ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ২৪৬২৫, মৃত ৩০৪০। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল স্থপতি চিকিৎসক অ্যান্ডারস টেগনেল বলছেন, “সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, কিছু মানুষ মারা যাচ্ছেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে লকডাউন না করার সিদ্ধান্ত ভুল। আমরা সন্দেহভাজন প্রতিটি মানুষকে ধরে ধরে পরীক্ষা করেছি। আলাদা রেখেছি। চিকিৎসা দিয়েছি। তাতে ভাল কাজ হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ইস্টারে বাড়লেও এখন কমছে। কেয়ার হোমে থাকা বয়স্কদের আরও বেশি নিরাপত্তা দেওয়া গেলে মৃত্যুহার আরও কমত। আমরা আপাতত সেই চেষ্টায় আছি। কমবয়সিদের নিষেধ করা হয়েছে যাতে সমস্যা না কমা পর্যন্ত বয়স্কদের সঙ্গে দেখা না করেন। এর পাশাপাশি আমরা আশা করছি সামনের মাসের মধ্যেই স্টকহলমের বেশ কিছু অংশে, যেখানে রোগ বেশি হয়েছে, হার্ড ইমিউনিটি পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে যাবে।”
হার্ড ইমিউনিটির এই তত্ত্বে ঘরে-বাইরে সমালোচিত হয়েছেন টেগনেল। সমালোচিত হয়েছে সুইডেন। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পও। কিন্তু তাতে পিছু হটেননি তাঁরা।
“পিছু হটার তো প্রশ্ন আসে না,” জানালেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। “রীতিমতো হিসেবনিকেশ করে, আটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছেন তাঁরা। তাঁরা জানেন কত জন অসুস্থ হতে পারেন, কত জন মারা যেতে পারেন আর কত জন সেরে উঠবেন। চিকিৎসা পরিষেবা ঢেলে সাজা হয়েছে। যাঁদের রোগ হলে বিপদের আশঙ্কা বেশি, তাঁদের ঘিরে রেখেছেন নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা বলয়ে। এত কিছু করার পর একটা রিস্ক নিয়েছেন। হিসেবনিকেশ করে নেওয়া রিস্ক, যাতে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”
সুইডেনের মডেলে আমরা চলতে পারি?
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন, “সুইডেনে ৪.৫ লক্ষ বর্গ কিমিতে থাকেন এক কোটি মানুষ, আর পশ্চিমবঙ্গে ৮৮ হাজার বর্গ কিমিতে ৯ কোটি। লকডাউনের অর্থ তো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও একসঙ্গে প্রচুর রোগীর চাপ ঠেকানো, সচেতন থাকলে ও সব দেশে তা এমনিই হয়ে যায়। আমাদের ১৩০ কোটির দেশে এ মডেল চলে কখনও! এ তো হাম বা মাম্পস নয় যে সংক্রমণ হলেও প্রাণ নিয়ে টানাটানি নেই। কোভিডে সংক্রমণ করিয়ে হার্ড ইমিউনিটি আনতে গেলে কম করে দু-কোটি মানুষ মারা যেতে পারেন। অপরিকল্পিত ভাবে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভেবে ইংল্যান্ড, ইটালি, আমেরিকাতে কী হল তা তো সারা পৃথিবী দেখছে। আমাদের দেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।”
কতটা ভয়াবহ হতে পারে, আসুন সে হিসেব দেখে নেওয়া যাক। হার্ড ইমিউনিটি থ্রেসহোল্ড বলে একটি সূচক আছে। যার অর্থ হল মহামারি কমাতে গেলে কত জন মানুষের মধ্যে সেই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তথা জোরদার অ্যান্টিবডি তৈরি হতে হবে। মাম্পসের ক্ষেত্রে যেমন ৯২ জনের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ গড়ে উঠলে বাকি ৮ জন নিরাপদ। কোভিড ১৯-এর হার্ড ইমিউনিটি থ্রেসহোল্ড এখনও পর্যন্ত যা বোঝা গিয়েছে তা হল ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ সমাজের ৭০ শতাংশ মানুষের রোগ হয়ে সেরে যাওয়ার পর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে বাকি ৩০ শতাংশ মানুষের নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা আছে। ১৩০ কোটির ৭০ শতাংশ এক বিশাল সংখ্যা। এ বার তাঁদের মধ্যে কম করে ১০ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, যার সংস্থান আমাদের দেশে নেই। মারা যাবেন কম করে দু-কোটি মানুষ। তার পর এত প্রাণের বিনিময়ে ক’দিনের সুরক্ষা পাওয়া যাবে?
সূত্রঃ আনন্দ বাজার পত্রিকা