ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতিকে নতুন কর্তৃত্ববাদী হুমকি বলে বর্ণনা করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো। শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি-৭ এর অন্য সদস্য দেশগুলোকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কুইবেকে জোটের শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে এক বৈঠকে ম্যাঁক্রো এই আহ্বান জানিয়েছেন বলে খবর দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। সম্মেলন শেষে দেওয়া যৌথ ঘোষণাকে দুর্বল না করতে জোট নেতাদের আহ্বান জানান ম্যাঁক্রো। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, প্রয়োজন পড়লে ‘জি-৬ প্লাস ওয়ান’ বিবৃতি দেওয়া হবে। আর ম্যাঁক্রোর এই হুঁশিয়ারির কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ট্রাম্প।
সম্প্রতি বাণিজ্য নীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জি-৭ এর অন্য ছয় দেশের নেতাদের মতবিরোধ বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে এক টুইটার বার্তায় ট্রাম্প দাবি করেছেন, ম্যাঁক্রো ও ট্রুডোর সরকার মার্কিন উৎপাদানকারীদের খরচ বাড়িয়ে ন্যায়হীন বাণিজ্য জালিয়ে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার খানিকটা অবজ্ঞার সুরেই তিনি টুইটারে লিখেছেন, ‘আগামীকাল তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আছি।’ পরের আরেকটি টুইটে তিনি বলেন, কানাডার বাণিজ্য নীতি আমাদের কৃষিখাতকে ধ্বংস করেছে।
উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় থাকলেও কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে ভর্তুকি এবং শুল্ক নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কানাডাতে তাদের দুগ্ধজাত পণ্যের প্রবেশাধিকার চায় আর কানাডা বলে আসছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাঠ পণ্যের ওপর অন্যায্য শুল্ক আরোপ করেছে। অটোয়া বলছে এসব বিরোধ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার কানাডা আর দ্বিতীয় বৃহত্তম দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে শুক্রবার সকালে কুইবেকে পৌঁছানোর কথা ট্রাম্পের। সেন্ট লরেন্স নদীর তীরবর্তী গ্রীষ্মকালীন অবকাশকেন্দ্র লা মালবাইয়েতে তার ট্রুডো ও ম্যাঁক্রোর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের কথা রয়েছে। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে এই সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা নেই ট্রাম্পের। তাদের সঙ্গে বিশ কিছুদিন ধরেই শীতল সম্পর্ক চলছে ওয়াশিংটনের। জি-৭ সম্মেলন শেষ করে শনিবার ভোরেই সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা দেবেন ট্রাম্প। সেখানে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা রয়েছে।
নিজেদের মধ্যে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় ট্রুডো ও ম্যাঁক্রো ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে আলোচনা ও সৌজন্যতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ট্রুডো বলেন, ‘দীর্ঘ দিনের বন্ধু ও মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনার জন্যে জি-৭ একটি সুযোগ।’
জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করায় ট্রাম্পের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন ট্রুডো-ম্যাঁক্রো। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা একই ধরনের মার্কিন পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আর নিজেদের অভিযোগ নিয়ে গেছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে।
ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপকে একপক্ষীয় আর অবৈধ হিসেবে বর্ণনা করেন ট্রুডো। তিনি বলেন, ট্রাম্পের এই অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের কারণে নিজের নাগরিকেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রশাসনের পদক্ষেপের কারণে আমেরিকানরা কাজ হারাতে যাচ্ছে।
তবে নিজের বক্তব্যে ম্যাঁক্রো ট্রুডোর চেয়েও বেশি কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘জি-৭ এর অন্য ছয় দেশের বাজার আমেরিকার বাজার থেকেও বড়। আমি সহযোগিতা এবং জোটবদ্ধতায় বিশ্বাস রাখি কারণ আমাদের শক্তি দিয়ে আমরা কর্তৃত্ববাদীতাকে রুখে দেব।’
ট্রুডোর সভাপতিত্বে জি-৭ সম্মেলনের সফলতা আনতে নিজের ক্ষমতার সবকিছু করবার অঙ্গীকার করেন ম্যাঁক্রো। শনিবার সম্মেলন শেষে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার বিষয়েও সহযোগিতা করার কথা বলেন তিনি।
তবে তিনি বলেন, অন্য দেশগুলোরও জি-৬ প্লাস ওয়ান ফলাফলের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। ট্রাম্প স্বাক্ষর না করলেও অন্য দেশগুলো যেন নিজেদের মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটাতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান তিনি।
গত বছর সিসিলিতে জি-৭ শীর্ষ বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে সব দেশ স্বাক্ষর করেছিল। তবে বিবৃতিতে স্পষ্ট ছিল যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রবল মতবিরোধ রয়েছে।
ম্যাঁক্রো বলেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট মন খারাপ করবেন না, আর দরকার পড়লে ছয় দেশের চুক্তি হলে আমরাও মন খারাপ করবো না। তিনি বলেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন কর্মজীবীরাই এর প্রথম দুর্ভোগ পোহাবে।
ম্যাঁক্রো বলেন, আমরা সবাই সিরিয়া, ইরাক, সাহিল আর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে জড়িয়ে আছি। আমরা মিত্র। আমাদের সেনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা ও আমাদের মূল্যবোধ রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মিত্রদের মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে না। আমার জন্য এটা নীতির প্রশ্ন।