নজমুল কবিরঃ ক্রমবর্ধমান ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রাণের দাবী একটি সর্বজন স্বীকৃত গ্রহণযোগ্য এবং কমিউনিটি কল্যাণে নিবেদিত ‘বাংলাদেশ সমিতি, ফ্রান্স’। ফ্রান্সে আসা অব্দি শুনে আসছি এমন একটি নেতৃত্বের কথা, অভিভাবকহীনতার আক্ষেপের কথা। সভা-সমিতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানে যথারীতি শুনে আসছি ‘ফ্রান্সে আমরা অভিভাবকহীন, গ্রহণযোগ্য, সৎ এবং গতিশীল নেতৃত্ব দিয়ে কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে পাশে থাকবে।
প্রবাসী সকলের ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠবে ‘বাংলাদেশ সমিতি।’ এমন নির্মোহ নেতৃত্ব কোথায় মিলবে? বহুধা বিভক্ত এই কমিউনিটি যত বড় হচ্ছে, ততই তার বিভক্তির ডালপালার বিস্তৃতি ঘটছে।
বিগত ২/৩ বছর যাবৎ প্যারিসের যাপিত সংস্কৃতিতে রমজানের দিনগুলোতে ইফতার মাহফিলে বিভাজন-বিপন্ন কমিউনিটিতে এক মঞ্চে কথা বলা, একই টেবিলে খাবার খাওয়া ইত্যাদি ‘চোখ শীতলকারী’ দৃশ্য দেখা যায়। কমিউনিটির ভেতরে একটি আশার ঝিলিক দিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় প্যারিসে সাংবাদিক সমাজ ‘প্রভাবক’ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ – একথা সকলেই স্বীকার করবে বলে আশা করা অমীলক হবে না। কেননা সাংবাদিকদের ভেতর বিভক্তি আছে, একাধিক প্রেসক্লাব আছে, কিন্তু তারা এই বিভক্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে এক টেবিলে চা পান করে। মন খুলে কথা বলে। সম্প্রীতির এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত বটে। এই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য সংগঠনও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয় বৈ কী!
‘কমিউনিটির ঐক্য প্রক্রিয়া’র বহুচর্চিত কথা আবারও উঠে আসে ফ্রান্স বাংলা প্রেসক্লাবের ইফতার মাহফিলে। সেখানে উপস্থিত দুই প্রধান দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। উভয়ই অত্যন্ত চমৎকার করে বিভক্তির বিষয়টি তুলে এনেছেন। তারা তাদের রাজনৈতিক ভেদাভেদকে সরিয়ে রেখে বরং সম্মিলিত এবং গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের কথা বলেছেন। তবে সামাজিক এবং কমিউনিটিকেন্দ্রিক এই উপস্থিতিকে ‘কতিপয় সাংবাদিক’ ছবি তুলে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে বলে গুরুতর অভিযোগ করে। এটি সত্যিই পীড়াদায়ক। এই দায় এখানে কর্মরত সাংবাদিক সমাজ যেমন এড়াতে পারে না। তেমনি এই সাংবাদিকদের ‘স্খলিত এবং নীতিবিগর্হিত’ কাজ করতে রাজনৈতিক তথা কমিউনিটি নেতারাই শিখিয়েছেন বলে – সাংবাদিক সমাজ থেকে প্রতিবাদ এসেছে।
দ্বিতীয়বার ‘কমিউনিটির নেতৃত্ব সংকট’ নিয়ে আলোচনা উঠে আসে ফ্রান্সে শীর্ষ সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফ্রান্স (বিসিএফ) এর ইফতার মাহফিলে। এই সংগঠনটির নানা অনুষ্ঠানে কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত থাকে। উক্ত ইফতার মাহফিলে উপস্থিত বক্তারা তাদের আক্ষেপের কথা বলেন, চেয়ার নিয়ে টানাটানির কথা বলেন, সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বলে কমিউনিটির বিভক্তিকে আরো বিপন্নতার দিকে ঠেলে নেয়ার অভিযোগের কথা বলে। এই বক্তব্যের সূত্র ধরে প্যারিসে নেতৃত্বের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয় উঠে আসে, কথিত ‘বড় ভাই, অভিভাবক’ এর অতি ভক্তির নষ্টামীর অভিযোগ তোলা হয়। নিজেকে ‘বড় নেতা’ ঠাহর করে নিজেদের কিছু পছন্দের মানুষকে নিয়ে একটি ‘সংকীর্ণ কমফোর্ট জোন’ তৈরি করে বিভক্তির আয়ুকে বাড়িয়ে রাখা হয়। এদের সাথে কমিউনিটির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার কোনো যোগসূত্র নেই। নিজের নেতৃত্ব বজায় রাখতে এমনটি চলছে।
কমিউনিটির বহুমাত্রিক বিভাজনের বিষয়টি আবারও উঠে আসে ‘ফ্রান্স দর্পণ’ পত্রিকার ইফতার মাহফিলে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারাও সেই ‘ঐক্যবদ্ধ কমিউনিটির’ অনুপস্থিতির হাহাকারের কথা উচ্চারিত হয়। অবশ্য এইক্ষেত্রে বক্তারা সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতার কথা বলা হয়, সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলবার লেখনীর কথা বলা হয়। কমিউনিটির ভেতর নানা অনিয়ম, সমস্যা এবং সম্ভাবনার কথা তুলে আনা হয়।
কমিউনিটিতে এই যে ‘সর্বজন স্বীকৃত, গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের’ অভাব, এর থেকে উত্তোরণের উপায় কী? সকলেই একবাক্যে বলে থাকেন, চেয়ার তথা পদ-পদবীর প্রতি নির্মোহ থাকা। কিন্তু পদ-পদবী ছাড়া তো নেতৃত্ব নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্মোহ উদ্যোগ দরকার। এই উদ্যোগ কিভাবে শুরু হতে পারে?
একটি সর্বজন গ্রহনীয় ‘বাংলাদেশ সমিতি’র খোঁজেঃ একটি প্রস্তাবনা।।
একটি চমৎকার নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ সমিতি’র নেতৃত্ব নির্বাচন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিকতা বিবর্জিত একটি পরিশীলিত দৃষ্টিভঙ্গী থাকবে। একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচকের ভূমিকায় থাকবে ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাননীয় রাষ্ট্রদূত কিম্বা তার প্রতিনিধি। তাকে সহায়তা করার জন্য কমিউনিটির প্রবীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবি, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের থেকে ১০ জন সহকারী নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনে ভোটার হবেন, এদেশে নিবন্ধিত সামাজিক সংগঠনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকগণ। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ২/৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। মেয়াদ শেষ হবার সাথে সাথে তাদের পদত্যাগ করতে হবে। তার আগে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
আমরা সকলে শুধু বলতেই থাকবো, সম্মিলিত নেতৃত্ব চাই, ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব চাই। কিন্তু কিভাবে তা চাই? তার কোন পথ আমরা বাতলে দেই না! আমার ব্যক্তিগত মতামত এটি। আমার বিশ্বাস এর থেকেও উত্তম প্রক্রিয়া হয়তো অনেকের মাথায়ই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের শানিত চিন্তার প্রতিফলন ঘটানো দরকার। দরকার একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব, এবং তা এখনই।
লেখক: বার্তা সম্পাদক ,ফ্রান্স দর্পণ