চন্দ্রানী চন্দ্রা : সারা বিশ্ব দেখলো ইরানের সাহস। ইরান সাহসের সঙ্গে টানা ১২ দিন যুদ্ধ করলো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরায়েলের সাথে। যে যুদ্ধটা মূলত শুরু করেছিল ইসরায়েল, তবে শেষ পর্যন্ত তাদের নত হতে হয় ইরানের কাছেই। এই যুদ্ধে ইরানকে লড়াই করতে হয় বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও।
ইরান মাথা নোয়ায় না। যার প্রমাণ মাত্র কয়েকদিন আগেই দেখেছে সারা বিশ্ব। ইরানের বহুদিনের পুরনো শত্রু ইসরায়েল। ইসরায়েল এমন একটা দেশ যারা মধ্যপ্রাচ্যে সবসময়ই অস্থিরতা বাজায় রাখে। সম্প্রতি নেতানিয়াহুর দেশ একপ্রকার ইচ্ছাকৃতভাবেই যুদ্ধে জড়ায় ইরানের সাথে। শুধু তাই নয় এই যুদ্ধে তারা জড়ায় বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকেও।
পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে ইরান, এমন অভিযোগ থেকেই তেহরানসহ বেশ কয়েকটি শহরে ১৩ জুন আকস্মিক বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। মুহূর্তেই লেগে যায় দুই পক্ষের সামরিক সংঘাত। যুদ্ধের ময়দানে নেতানিয়াহুর সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা হামলা চালায় মার্কিন বিমান বাহিনী। যার মাধ্যমে সংঘাতের পরিধি আরও ঘনিভূত হয়।
১৩ জুন, আচমকা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক ভবনকে লক্ষ্য করে অতর্কিত হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আকাশে ছুটে যায় আলোকিত উল্কার মতো ড্রোন— জানিয়ে দেয় ধ্বংসের আগমন। এই অভিযানের নাম— অপারেশন রাইজিং লায়ন (Operation Rising Lion)। হামলার নেপথ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পরমাণু প্রকল্প, সেনা ঘাঁটি, এবং দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাসভবন। এই ভয়াবহ আক্রমণের পরও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি ভেঙে পড়ে না— বরং গর্জে ওঠে তেহরান। পাল্টা অভিযান শুরু হয় দিগন্তজুড়ে। একই দিনে, ভোররাতে ইরান ছুড়ে দেয় প্রতিশোধের আঘাত— ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আছড়ে পড়ে পাল্টা হামলার ঝড়।
এই যুদ্ধে ইরান সারা বিশ্বকে দেখায় তাদের অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি এর প্রভাব। যাতে একপ্রকার নাস্তানাবুদ হয় ইসরায়েল। উপায় না দেখে তারা সাহায্য চায় বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। শেষে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও জড়ায় ইরানের সাথে যুদ্ধে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ইরান শুরু করে তার বহুল প্রতিক্ষিত অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস – আইআরজিসি জানিয়েছে, ট্রু প্রমিজ থ্রির আওতায় তারা ২৩ জুন পর্যন্ত বহু হামলার ঢেউ চালিয়েছে। এসব হামলায় লক্ষ্যবস্তু ছিল তেল আবিব, হাইফা, বিয়ারশেভার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর, ইসরায়েলের নেভাতিম ও হাটজেরিম বিমান ঘাঁটি, সামরিক কমান্ড সেন্টার, ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সেইসব বেসরকারি কোম্পানি যারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়। আইআরজিসি জানিয়েছে, এই লক্ষ্যবস্তুগুলো এমন এলিমেন্ট যারা ২০২৩ সালের আল-আকসা স্টর্ম অপারেশনের পর থেকে গাজা, লেবানন এবং ইয়েমেনে যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত। অন্যভাবে বললে, এই তালিকা দীর্ঘদিন ধরেই প্রস্তুত ছিল, সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের সময় আইআরজিসি তা কেবল বাস্তবায়ন করে।
এবারের হামলাগুলো ছিল ব্যতিক্রম। ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবস্থার নির্ভুলতা এতটাই বেড়েছে যে একাধিক ইসরায়েলি স্থাপনায় সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে তারা। এমনকি ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও একাধিক জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে এসব আক্রমণ ঠেকাতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা স্পষ্ট যে ইরান শুধু প্রতিশোধ নেয়নি, তারা নিজেদের আক্রমণক্ষমতা বিশ্বের সামনে নতুন করে তুলে ধরেছে। এই অভিযানে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র বা প্রযুক্তি নয়, অংশ নিয়েছে পুরো ইরানি জনগণ। রাজধানী তেহরান থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা দেশে বসবাসরত ইরানিরা রাস্তায় নেমেছে ‘রাধ এন্ড ভিক্টরি’ শ্লোগান নিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের এই প্রতিবাদ জানিয়ে দিয়েছে, এই যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্রীয় নয়, এটি একটি জাতির সম্মান রক্ষার লড়াই।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় যখন যুক্তরাষ্ট্রও এ যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থপনায় হামলা চালায়। তবে এরফলে ইরান যেন হয়ে ওঠে আরও সাহসী। খামেনির দেশ তখন টার্গেট করে মধ্যপ্রাচ্যের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোকে। যা হয়তো বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র কল্পনাও করেনি।
যুদ্ধে ইসরায়েল একা যখন ইরানের সঙ্গে পেরে উঠছিল না তখনই নেতানিয়াহু সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের দশম দিনে—২২ জুন, যুক্তরাষ্ট্রও মাঠে নামে। আকাশে গর্জন করে আসে বি-টু বোমারু বিমান, ইরানের আকাশে নামে আগুন। স্থানীয় সময় রাতে হঠাৎই কেঁপে উঠে ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইস্পাহানের পারমাণবিক কেন্দ্র। ট্রাম্প প্রশাসন চালায় এক নির্দয় অপারেশন। ব্যবহার করা হয় সেই ভয়ংকর অস্ত্র—বাঙ্কার বাস্টার বোমা, যা ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের, ভেতরে ঢুকে ফাটে মাটির গভীরে। এই বোমাগুলো ছোড়া হয় মাটির নিচে থাকা ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে, যার নাম— জিবিইউ-57 ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর। এ যেন শুধু হামলা নয়, এক ভয়ংকর বার্তা— যা বাতাসে ছড়িয়ে দেয় যুদ্ধের গন্ধ, আর চোখে চোখ রাখে এক জেদী জাতির সঙ্গে।
এই হামলা তেহরানকে ফেলে দেয় এক জটিল চাপে। প্রতিশোধ চাই, তবুও প্রতিপক্ষ যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ! এখন প্রশ্ন— ইরান কী মুখ রক্ষা করবে, না কি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলবে? এই দ্বিধার মাঝেই খামিনির ইরান বেছে নেয় এক সাহসিক পথ। তারা মাথা নোয়ায় না, তারা থামে না। ইরান গড়ে তোলে এমন এক দৃঢ় অবস্থান, যা দেখে বিশ্ব বুঝে যায়— এই দেশ কারও হুমকিতে কাঁপে না। এই জাতি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শত্রুর চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে জানে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালায় খামেনি প্রশাসনও। কাতারে আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরানও। মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছে, কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ইরান স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। মূলত এই হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৪ জুন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।
ইরানের কাছে দাঁত ভাঙ্গা জবাব পাওয়ার একদিন পর ২৪ জুন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামিনি যেন হয়ে উঠেছেন এক অনবদ্য দৃঢ়তার প্রতীক। সাম্প্রতিক এই যুদ্ধে ইরান যেন কাঁপিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে। আর সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিলো এক বার্তা। ভয় নয়, সম্মান চাই!
একটি দ্বন্দ্ব থেমেছে, কিন্তু প্রশ্ন জেগে থাকে— নাজুক যুদ্ধ বিরতিতে- এ থেমে যাওয়াটা কি সত্যিই স্থায়ী? নাকি এ যুদ্ধবিরতি শুধু নতুন আগুনের আগে মেঘলা নীরবতা?
“চন্দ্রানী চন্দ্রা, নিউজ টোয়েন্টিফোর”