দর্পণ রিপোর্ট : ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৩ জুন, সোমবার, বিকাল ৫.০০ ঘটিকায় ‘অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এরউদ্যোগে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে “পলাশী ট্র্যাজেডি ওআজকের বাংলাদেশ” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কবি আহমেদ ময়েজ, স্বাগতবক্তব্য রাখেন অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাতআরিয়ান খান এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব শামসুল আলম লিটন।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাপ্তাহিক সুরমা’র প্রধানসম্পাদক ফরীদ আহমেদ রেজা এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিতছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ ও অধ্যাপক আবদুলকাদির সালেহ।
অতিথি হিসেবে কানাডা থেকে আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নেনলেখক ও ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক ড. তাজ হাশমী।
আলোচনায় আরো অংশ নেন দৈনিক সিলেটের ডাক সম্পাদকনজরুল ইসলাম বাসন, সাবেক কাউন্সিলর লেফটেন্যান্ট (অব🙂 ইমরান আহমেদ চৌধুরী, স্পেকট্রাম রেডিও ইউকের পরিচালকমিছবাহ জামাল, গবেষক ড. কামরুল হাসান, দৈনিক আমার দেশ এরনির্বাহী সম্পাদক (আবাসিক) অলিউল্লাহ নোমান, লেখক ও গবেষকশেখ আখলাখ আহমেদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্টবদরুজ্জামান বাবুল, ইন্জিনিয়ার মুগনি চৌধুরী ও মানবাধীকার কর্মীহাসনাত হাবীব প্রমূখ।
সভা সঞ্চালনা করেন সাপ্তাহিক সুরমা’র ব্যবস্থাপনা সম্পাদকমিনহাজুল আলম মামুন ও সানরাইজ টুডে সম্পাদক এনাম চৌধুরী।
স্বাগত বক্তব্যে হাসনাত আরিয়ান খান অখণ্ড বাংলাদেশআন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পটভূমি তুলে ধরেন এবং নবাবী বাংলা ফিরেপেতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “এমাটি আমার, এ মাটি আপনার। এ মাটি আমাদের সবার। আমরাছেড়ে দিবো না এ মাটির অধিকার। তিনি আরও বলেন, “প্রকৃতপক্ষেপলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ–উদ–দৌলা একাপরাজিত হননি, পরাজিত হয়েছিলো বাংলা–বিহার–উড়িষ্যার জনগণ।এই পরাজয়ের গ্লানি আমাদের মুছতে হবে।” তিনি পলাশী ট্র্যাজেডিথেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ এর জুলাই গণবিপ্লবকে বেহাত হওয়া থেকেরক্ষা করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
মূল প্রবন্ধে শামসুল আলম লিটন বলেন, “আজ ২৩ জুন, এইতারিখটি আমাদের জীবনে একটি কলঙ্কিত দিন। এই দিনে আমাদেরস্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় দাসত্বের এক দীর্ঘ অন্ধকারঅধ্যায়। নবাব সিরাজ–উদ–দৌলা একজন অল্পবয়সী, সাহসী, স্বাধীনচেতা শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবযিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও লুটতরাজের বিরুদ্ধে রুখেদাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশীয়কিছু ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে। এটি ছিলো বিদেশি শক্তির সঙ্গেদেশীয় বেঈমানদের যুগলবন্দির এক ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। পলাশীরযুদ্ধ শুধু একটি পরাজয় ছিলো না, এটি ছিলো আমাদের জাতীয়আত্মমর্যাদার পরাজয়। কিন্তু এর পেছনে কিছু বাস্তব কারণও ছিলো যাআমাদের উপলব্ধি করতে হবে। একদিকে ব্রিট্রিশরা তখন আধুনিকযুদ্ধ সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের যুদ্ধ শক্তি নিয়ে নামছিলো। বারুদেরবন্দুক, কামান, সমন্বিত বাহিনী, আর্ন্তজাতিক কুটনীতি সব ছিলোতাদের পক্ষে। অথচ নবাব সিরাজ–উদ–দৌলার বাহিনী তখনও ছিলোঘোড়া ও তলোয়ার নির্ভর। এমনকি তাঁর কামানের গোলাগুলি বৃষ্টিতেভিজে গিয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিলো। মাত্র একটিত্রিপাল না থাকায়…ভাবুন একটি সামান্য কাপড়ের অভাবে ইতিহাসকিভাবে বদলে যায়! প্রিয় ভাইয়েরা আজকের বাংলাদেশও কি তেমনবিপদের মুখোমুখি নয়? আমরা কি আরেকটি পলাশীর মুখোমুখি হচ্ছিনা? আজও কি কিছু সুবিধাবাদী দেশীয় গোষ্ঠী বিদেশি শক্তির সমর্থনেআবার এই জাতিকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে না? আজওআমরা প্রযুক্তিতে ও সামরিক দুরদর্শীতায় এবং কুটনৈতিক প্রজ্ঞায়পিছিয়ে আছি। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্রশাসনেদুর্নীতি, শিক্ষায় নৈতিকতার অভাব, বিচার ব্যবস্থায় পক্ষপাত, সবকিছুমিলে আমাদের একটানা অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা ভুলেযাচ্ছি পলাশী শুধু ইতিহাস নয়, পলাশী এক চেতনার নাম। পলাশীএকটি জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবোধের চেতনা, স্বাধীনতা ওআত্মমর্যাদার চেতনা। আমরা যদি সিরাজ–উদ–দৌলার মত তরুণনেতৃত্ব গড়তে না পারি, যদি মীর জাফরদের মত বিশ্বাসঘাতকদেরচিহ্নিত করতে না পারি, যদি প্রযুক্তি জ্ঞান, ইমান ও বিশ্বাসের সমন্বয়েজাতিকে গড়তে না পারি, আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হতে না পারি, তবেআমাদের পরিণতি পলাশীর পুনরাবৃত্তির দিকেই যাবে। আজকের এইদিনে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শপথ করি, আমরা আরকোন মীরজাফর তৈরী হতে দিবো না, আমরা আবার গড়ে তুলবোএকটি বিশ্বাস নির্ভর, প্রযুক্তি নির্ভর, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একটিজাতি। আসুন সবাই মিলে জাতীয়তাবাদ, মূল্যবোধ ও মুক্তচিন্তা নিয়েনতুন বাংলাদেশ বা অখণ্ড বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরাদেখি তা গড়ে তুলি। নবাব সিরাজ–উদ–দৌলার অসমাপ্ত কাজকেআমরা সম্পন্ন করবো ইনশাআল্লাহ।”
অতিথি হিসেবে আলোচনা সভায় ড. তাজ হাশমী বলেন, “পলাশী যুদ্ধে তথ্য ও প্রযুক্তি, রণকৌশল, সিপাহশালারদের বেঈমানী – বড়দাগে ছিলো বিশ্বাসের ঘাটতি। সেনাপ্রধান মীরজাফরেরবিশ্বাসঘাতকতা, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো বাকী সব ব্যবস্থাপনা। তিনি আরো বলেন, “আমরা যেভাবে ইতিহাসটা পড়ি তার প্রভাবপড়েছে আমাদের চিন্তাধারায়। আমাদের দেশে যার ডাক্তারী, ইন্জিনিয়ারিং, ইকোনোমিস্ট পড়বের তার সাথে ইতিহাসের পরিচয় হয়না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন বলেন, সেখানে তাদের দেশেরইতিহাস ও পৃথিবীর ইতিহাস, বিশেষ করে ইউরোপের ইতিহাস, ফরাসীবিপ্লবের ইতিহাস এবং বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য।আমাদের দেশের মেডিকেল পড়ুয়ারা বলবে আমি ডাক্তারী পাশকরবো, আমি আবার ইতিহাস পাঠ করবো কেনো?” তিনি দেশেরমানুষের ইতিহাস চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী হয়ে আছেপলাশীর যুদ্ধ। আর এই ষড়যন্ত্রের কুশীলব ছিলেন নবাবের প্রধানসেনাপতি মীর জাফর। সাথে ছিলো জগৎশেঠ, ঘষেটি বেগম, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ ও উমিচাঁদ গংরা। কোন বাঙালিই তার সন্তানেরনাম “মীর জাফর” রাখে না। নবাব সিরাজ–উদ–দৌলার চরিত্রেকালিমা লেপনের চেষ্টা করেও পারা যায়নি। নানা গবেষণায় প্রমাণিতহয়েছে, তিনি ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, প্রজাবৎসল নবাব।চরম বাঙালি বিদ্বেষী বর্ণবাদী রবার্ট ক্লাইভের কুটচাল এবং কিছুবিশ্বাসঘাতকের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পলাশীর প্রান্তরে তাঁরপতনের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্যের অস্ত ঘটে। একইসঙ্গেপুরো উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের পথ মসৃণ হয়ে যায়। সেদিন যদিসবাই সিরাজের পাশে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন, তাহলে বাংলা–বিহার–উড়িষ্যা আজ আলাদা হতো না। হাসনাতআরিয়ান খানের মত তরুণেরা নবাবী বাংলা ফিরে পেতে আন্দোলনকরছে। অখণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। একদিন তাদের স্বপ্নসফল হবে। আমি তাদের সফলতা কামনা করি।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আবদুল কাদির সালেহ বলেন,“১৭৫৭ সাল থেকে আজকে ২০২৫ সাল, পলাশীর যে ট্র্যাজেডি, তার যে শিক্ষা তা আজও কিন্তু সমানভাবে আমাদের জন্যপ্রযোজ্য। সেজন্যই বার বার পলাশী আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়েআসে। তার আলোচনা খুব জরুরি হয়ে ওঠে। সেই সময় ৮০০বছরের সাম্রাজ্যের কেনো পতন হলো এবং কী কারণে আমরাআমাদের স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারিনি, এর পেছনে কী কী কারণছিলো, এই কারণগুলো অনুসন্ধান করে তার ভিত্তিতে যদি আমরাআমাদের চিন্তা, চেতনা, জাতীয়তা, আমাদের সংস্কৃতি আমরা যদিনির্মাণ করতে পারি তাহলে আমরা আবার স্বাধীন সত্তা নিয়েদাঁড়াতে পারবো। সে কারণে পলাশীর আলোচনা, পলাশী দিবসকেচেতনার একটা দিবস হিসেবে নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক এবংজরুরি। আমি এটা মনে করি। এক ধরনের চেতনা থেকে বিভিন্নবয়ান তৈরী হয়। এসব বিকৃত বয়ান বা চেতনাকে চ্যালেঞ্জ করতেহবে। তবেই ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হবে।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরীদ আহমেদ রেজা বলেন, “আমাদের বসেথাকলে চলবে না। আমাদের নতুন প্রজন্ম যারা আছে, যারা ইতিহাসবিস্মৃত, তাদেরকে ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। আরো বড়পরিসরে করতে হবে। তবে শুরু করার জন্য আমি অখণ্ড বাংলাদেশআন্দোলন এর আহবায়ক হাসনাত আরিয়ান খানকে ধন্যবাদজানাই। তার কারণেই আজকে আমরা এই সমাবেশে জড়ো হতেপেরেছি। বিজ্ঞ আলোচকদের অনেক মূল্যবান কথা শুনে আমরাসমৃদ্ধ হয়েছি। যখন জুলাই বিপ্লব হলো তারা যখন শ্লোগান দিলোআবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ, তখন আমি ঢাকায় যারা উপদেষ্টাহয়েছেন তাদের কয়েকজনকে আমি ওইদিন একটা মেসেজদিয়েছিলাম। আমি তাদেরকে বলেছিলাম একথা যে আপনার যদিবিপ্লবী সরকার গঠন না করেন, আপনারা যদি চুপ্পুকে না সরানতাহলে বিপ্লব হাত ছাড়া হয়ে যাবে। পৃথিবীতে অনেক বিপ্লব হাতছাড়াহয়েছে। সুতরাং আমরা চাইনা এটা হাতছাড়া হোক। মীরজাফরপ্রথমবার যখন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, নবাব যদি তখন তারবিরুদ্ধে কঠোর হতেন তাহলে মীরজাফরসহ বাকিরা আরবিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পেতো না। ২৪ এর বিপ্লবের সাথে যারাবিশ্বাসঘাতকতা করবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে কঠোর হতে হবে।মোহনলাল, মীর মদনরা নবাবের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে জীবনদিয়েছিলেন পলাশীর যুদ্ধে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।আমাদেরকে একসাথে আবার লড়তে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকেএসব ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলার প্রশাসনিক দুর্বলতা, সাম্প্রদায়িক উপাত্তকে চিহ্নিত করতে হবে।“
দৈনিক সিলেটের ডাক এর সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন বলেন, “আজ ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীরপ্রান্তরে, স্বল্প সময়ের একটি ছোট যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় পৃথিবীরইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ও ভয়াবহ অর্থনৈতিক লুন্ঠনের এক অধ্যায়।শুধু বাংলার স্বাধীনতা নয়, হারিয়ে যায় এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক আত্মমর্যাদা এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। পলাশীর যুদ্ধ ছিলআসলে একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থান, যার পেছনে ছিল ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি—বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরদের মতো দেশীয়সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে। বর্তমান সময়েও আমরা প্রায় ইতিহাসেরএকই প্লাটফর্মে ঘুরছি। যদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জেনজি প্রজন্মআবাবিল পাখির মতো বেরিয়ে না আসতোম, তাহলে নতুন করেভাবার অবকাশ আমরা পেতাম না। জুলাই গণবিপ্লবকে যেকোনোমূল্যে রক্ষা করতে হবে।”
স্পেকট্রাম রেডিও ইউকের পরিচালক মিছবাহ জামাল বলেন, “ইতিহাসের পরতে পরতে আমরা যেসব ভুল করেছি, সেসব ভুল থেকেআজো আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। ইতিহাস থেকে যদি শিক্ষানা নেওয়া হয়, তবে তা বারবার ফিরে আসে ভিন্ন রূপে। আজকেরবাংলাদেশ যদি সত্যিকারের অর্থে তার সকল খণ্ডের স্বাধীনতা চায়, হাত–পাগুলো যুক্ত করতে চায়, তাহলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকস্বাধীনতার জন্যও সংগ্রাম করতে হবে এবং সেই সংগ্রামের প্রেরণা হতেপারে পলাশী।
গবেষক ড. কামরুল হাসান বলেন, “আমাদের ইতিহাসকে আমরা এত বেশি আড়ালে রাখি.. যেন ভুলেই গেছি! অথচ এগুলো বেশিবেশি চর্চিত হবার বিষয়! ইতিহাস যখন আমরা চর্চা করি তখন নতুনজিনিস আমরা আনতে পারি না। আজকের এই বিয়োগান্তক দিনেআওয়ামী লীগের জন্ম। তারা পলাশী দিবস পালন করে না। তারাতাদের দলের জন্ম উৎসব করে। আজও তারা উৎসব করছে।ইতিহাস নিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করতে হবে। ইতিহাস চর্চাকরতে হবে।”
লেখক শেখ আখলাখ আহমেদ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে এম আরআখতার মুকুলের পঠিত চরমপত্র শোনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “ন্যারেটিভ জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৭১ এর পরে অনেক বয়ান তৈরীহয়েছিলো। কিন্তু ২৪ এর জুলাই বিপ্লবের পরে কোন বয়ান তরী হয়নি।পলাশীর পরেও কোন বয়ান তৈরী হয়নি। আমরা বয়ান তৈরীতে ব্যর্থহয়েছি। আমাদেরকে ন্যারেটিভ তৈরী করতে হবে।”
সাবেক কাউন্সিলর লেফটেন্যান্ট (অব🙂 ইমরান আহমেদ চৌধুরীবলেন, “পলাশীর যুদ্ধ, এটা কোনো যুদ্ধ ছিলো না। সব কিছু একটাষড়যন্ত্রের ফসল। কিন্তু এই সময়কে একাডেমিকভাবে তুলে ধরাহয়নি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে, স্বল্প সময়ের একটিছোট যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ওভয়াবহ অর্থনৈতিক লুন্ঠনের এক অধ্যায়। শুধু বাংলার স্বাধীনতানয়, হারিয়ে যায় এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক আত্মমর্যাদা এবংরাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। পলাশীর যুদ্ধ ছিল আসলে একটিষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থান, যার পেছনে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়াকোম্পানি—বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরদের মতো দেশীয় সহযোগীদেরসঙ্গে নিয়ে। নবাব সিরাজ–উদ–দৌলার মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা নবাবেররাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে রাজকোষ থেকে সরাসরি নিয়ে যায়প্রায় ২৫ কোটি টাকা (সেই সময়কার)। আধুনিক মূল্যমান অনুযায়ীএটি প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। লর্ড ক্লাইভ নিজেই তখনকারইংরেজি মুদ্রায় ২,৩৪,০০০ পাউন্ড ঘুষ নেন, যা আজকের প্রায় ৩৬মিলিয়ন পাউন্ডের সমতুল। ব্রিটিশ সেনা ও অফিসাররাব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। স্থানীয় কৃষকদেরওপর চাপানো হয় দ্বিগুণ কর। জমিদারদের মাধ্যমে এই কর আদায়করা হতো সহিংস উপায়ে। এতে কৃষক ও তাঁতিরা দারিদ্র্যে ধ্বংস হয়।”
দৈনিক আমার দেশ এর নির্বাহী সম্পাদক (আবাসিক) অলিউল্লাহনোমান বলেন, “আমরা এখনো পরাধীনতার কবল থেকে বের হয়েআসতে পারিনি। সেই পরাজয়ের রেশ এখনও আমাদের সমাজেবিদ্যমান—রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে। আমাদের মসলিন, তাঁতশিল্প বা লোকশিল্প আজো যথার্থভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়নি।আমরা বিদেশি পণ্যকে শ্রেষ্ঠ মনে করি—যেখানে আমাদের নিজেরঐতিহ্য ছিল বিশ্বসেরা। সবাই চেষ্টা করলে অখণ্ড বাংলাদেশবাস্তবায়ন করা সম্ভব।”
ইন্জিনিয়ার মুগনি চৌধুরী ইসরায়লে ইরান যুদ্ধের উদাহরণ তুলে ধরেবাংলাদেশের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম শক্তিশালী করার ওপরগুরুত্বারোপ করেন। তিনি বাংলার আকাশ প্রতিরক্ষায় একক যোদ্ধাহিসেবে সর্বাধিক চারটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডধারীশফিউল আজমের মত পাইলট তৈরী করার কথা বলেন।
মানবাধীকার কর্মী হাসনাত হাবীব বলেন,“ আজ ২৩ জুন, পলাশীট্রাজেডির ২৬৮ বছর পূর্তি। ১৭৫৭ সালের এই দিনে বাংলারস্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। কিন্তু সেই হারানো স্বাধীনতার সূর্যআর উঁকি দেয়নি এই ভূখণ্ডের আকাশে। নবাব সিরাজ–উদ–দৌলারপরাজয় কোনো সাধারণ সামরিক ব্যর্থতা ছিল না; এটি ছিল ষড়যন্ত্র, বিভাজন, দুর্নীতি, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও জনসচেতনতার অভাবেরএক নিষ্ঠুর পরিণতি—যার ছায়া আজও আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতেস্পষ্ট। পলাশীর শিক্ষা হলো—জাতীয় ঐক্য, দূরদর্শী নেতৃত্ব, সততা, আত্মনির্ভরতা ও জনসচেতনতা ছাড়া স্বাধীনতা টেকসই হয় না।আমরা যদি বারবার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হই, ভবিষ্যতেওস্বাধীনতা ঝুঁকির মুখে পড়বে। আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে মানবিকঅবস্থান নিতে আমরা সচেষ্ট, যা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু আমাদেরপাশেই আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে যে বর্বরতা—গণহত্যা, ধর্ষণ, দমন–পীড়ন—তা নিয়ে আমরা নিরব। অথচ এই অঞ্চলটি ইতিহাসেরপ্রেক্ষিতে আমাদেরই অংশ, যা ১৭৮৫ সালে এই অঞ্চলটি আমাদেরথেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকশাসকগণ কর্তৃক মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত হয়। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানযেমন তার দাবিতে অনড়, তেমনি আমাদেরও উচিত আন্তর্জাতিকফোরামে আরাকান নিয়ে আওয়াজ তোলা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবেগত ৫৩ বছরে কোনো সরকারই এটি করেনি। এখন সময় এসেছেঐতিহাসিক অধিকার ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে আরাকান ইস্যুতেজাতীয় অবস্থান স্পষ্ট করা। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টাচালাতে হবে—এটাই হবে আমাদের ইতিহাসের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাও ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীলতা “
সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট বদরুজ্জামান বাবুল দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত বুদ্ধিজীবীদের অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে কবি আহমেদ ময়েজ বলেন, “আমি সবার বক্তব্যখুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি এবং সবার বক্তব্য নোট করেছি। ১৭৫৭সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়েছে। এর মাঝে গঙ্গা–ভাগীরথী দিয়ে অনেকজল গড়িয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টাও হয়েছে অনেক। ইংরেজ ওতাদের দোসররা মিলে দেশি–বিদেশি ফরমায়েশি লেখক ও তথাকথিতগবেষক দিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলার কসরতও কম হয়নি।সিরাজ–উদ–দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটামনুমেন্ট তৈরী করা হয়েছিলো। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৮৯৮ খ্রি. প্রকাশিত তাঁর “সিরাজ–উদ–দৌলা” গবেষণা গ্রন্থে যুক্তি–প্রমাণ দিয়েমনুমেন্ট তৈরী শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচার বলে প্রমাণ করেন।পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবংমাওলানা আকরাম খানের উদ্যোগে ১৯৩৬ খ্রি. ২৩শে জুনকলকাতায় প্রথম পলাশী দিবস পালন হয়। ১৯৪০ খ্রি. বাঙালিহিন্দু–মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা বাধ্য হয় ওইহলওয়ে মনুমেন্ট তুলে নিতে। আমি বর্ডার লাইনে একটা কথা বলবোবিশ্বাসঘাতকতাই ছিলো মূল বিষয়। নবাব সিরাজ–উদ–দৌলার যেহেতুজনপ্রিয়তা ছিলো, লোকজন সিরাজকে ভালোবেসেছে, একারণেপলাশী যুদ্ধের পর সিরাজের চরিত্রে ইংরেজদের কালিমা লেপন করতেহয়েছে। মিথ্যা ইতিহাস, মিথ্যা বয়ান তৈরী করতে হয়েছে। ইংরেজদেরএসব করতে দেখেই বুঝা যায় নবাব সিরাজ–উদ–দৌলা কোনজনবিচ্ছিন্ন নবাব ছিলেন না। সিরাজ–উদ–দৌলার জনপ্রিয়তা নাথাকলে, নবাবের ওপর জনগণের আস্থা না থাকলে তাদেরকে এসবকরতে হতো না। এসব না করলে তারা প্রায় দুইশো বছর শাসন করতেপারতো না। কিন্তু ইতিহাস কারো কৃতদাস হয় না। তাই দেরিতে হলেওসত্য ইতিহাস বেরিয়ে এসেছে। আমাদেরকে এখন নতুন করে ইতিহাসলিখতে হবে। ইংরেজদের লিখিত ইতিহাস, ইংরেজদের লিখিতবয়ানকে চ্যালেন্জ করতে হবে।”
কারিগরি ক্রুটির কারণে বাংলাদেশ থেকে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকারসম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থসমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া ও মনোবিজ্ঞানী নাজমুল হোসাইনকে এবংকানাডা থেকে ড. হাসান মাহমুদকে আলোচনা সভায় যুক্ত করতে নাপারায় আয়োজকেরা দু:খ প্রকাশ করেন।
এসময় দর্পণ টিভির পরিচালক রহমত আলী, কবি কাইয়ুমআবদুল্লাহ, ড.মুহাম্মাদ মুঈনুদ্দীন মৃধা, সাংবাদিক শেখ মুহিতুররহমান বাবলু, ইক্যুয়াল রাইটস ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্টসাংবাদিক মাহবুব আলী খানশূর, মানবাধীকার কর্মী ইউসুফহোসাইনসহ কমিউনিটির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভা শেষে পলাশী থেকে আজ পর্যন্ত দেশের জন্য যারাজীবন দিয়েছেন, সেসব বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায়বিশেষ মোনাজাত করা হয়। আলোচনা সভায় ‘অখণ্ড বাংলাদেশআন্দোলন’ এর একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।