কাজী মোঃ শাহজাহান: ২৪ অক্টোবর ১৯৯৮ইং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সকল জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যদের গণভবনে আমন্ত্রণ করেন। তবে এ আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের জেলা কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ছাত্রলীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে আমিও সেই আমন্ত্রণপত্র পাই। সিলেট থেকে আমিসহ অন্য আমন্ত্রণপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতে ঢাকায় যাই। আমরা যাঁরা সিলেট থেকে ঢাকায় গিয়েছিলাম যতটুকু মনে পড়ে ক্যাপিটেল ও উপবন এই দুটি হোটেলে অবস্থান করি। তখনকার সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সফিউল আলম নাদেল ও সাধারণ সম্পাদক আমার বন্ধু নাসির উদ্দিন খাঁন ও আমি একই হোটেলে অবস্থান করেছিলাম। হোটেলে আমরা বেশ আনন্দমুখর সময় পার করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পূর্ব রাত অর্থাৎ ২৩শে অক্টোবর সবাই মিলে হোটেলে বেশ জমিয়ে আড্ডা দেই। যে আড্ডা রাত ২টার দিকে শেষ হয়। গভীর রাতে আড্ডা শেষ হওয়ায় ঘুমাতে দেরি হয় এবং সকাল বেলা যথাসময়ে ঘুমও ভাঙ্গেনি। ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন ঘড়ির কাটা ১১:৩০ মিনিট। ঘুম থেকে দেরি করে উঠায় তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করলাম। নাস্তা শেষ করে যখন গণভবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এমন সময় আমার রুমে এসে উপস্থিত জেলা ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার আলী ও বদরুল ইসলাম। আমি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রুমে আছেন না চলে গেছেন। তাঁরা বলল রুমে নক করেছিলাম কেউ উত্তর দেয়নি, মনে হয় চলে গেছে। যাইহোক আমরা তিনজন একটি সিএনজিতে গণভবনে গেলাম। গেইটে যাওয়ার পর সহকর্মীদের একটু খোঁজ নিলাম। সিকিউরিটিদের কাছ থেকে আমাদের সিলেটের লিস্টটি দেখে নিলাম এবং আমাদের পাসটি সংগ্রহ করে গণভবনের ভিতরে প্রবেশ করলাম। গণভবনের হল রুমে যখন আসন গ্রহণ করি তখন ঘড়ির কাটা ২টা বাজে।
প্রধানমন্ত্র্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা হল রুমে উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানালাম এবং তিনি আসন গ্রহণ করলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে শুধু তাঁর সিকিউরিটি এসএসএফ এবং ব্যক্তিগত সহকারী ও ছাত্রনেতা রবিউল ভাই। এখানে উল্লেখ করে রাখি, গণভবনের এ সভায় আওয়ামী লীগের জেলা কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাকে যেহেতু আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তাই তাঁদের কেউ এখানে উপস্থিত ছিলেন না। সভার শুরুতে নেত্রী তাঁর স্বভাবসুলভ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলেন এবং পরিস্কার করে বললেন, শুধুমাত্র ছাত্রলীগ ব্যতীত আজকের এই সভায় আমি কোন পর্যায়ের কোন নেতাকে আমন্ত্রণ বা অনুমতি দেই নাই। কারণ আওয়ামী লীগ নেত্রীবৃন্দ উপস্থিত থাকলে আমার কানে প্রকৃত সত্য বা সঠিক তথ্য গোপন থেকে যাবে।
এক পর্যায়ে আসলো আমাদের বক্তব্যের পালা। প্রথমে ঢাকা জেলার ছাত্রলীগ নেত্রীবৃন্দ বক্তব্য দিলেন। তারপর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রীবৃন্দ। পরে আমি হাত তুললাম। নেত্রী অনুমতি দিলেন। আমার পরিচয় পেশ করলাম। পরিচয়ে বললাম – আমি কাজী মোঃ শাহজাহান, জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সিলেট। নেত্রী সাথে সাথে আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কার পকেট থেকে এসেছ? ‘কাক্কু’ না ‘স্পিকার সাহেব’ –এর পকেট থেকে? আমি একটু থমকে গেলাম কয়েক সেকেন্ড! আমি বললাম মাননীয় নেত্রী আমি কারো পকেটের লোক নই। তবে আমি আপনার পকেটের লোক তাই এখানে আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছি। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ কিংবা স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর লোক হলে কলাবাগান না হয় ধানমন্ডীর বাসায় থাকতাম, এখানে আসতাম না।
নেত্রী অনুমতি দিলেন, আমি একাধারে ১৫ মিনিট সিলেট সম্পর্কে বক্তব্য দিলাম। নেত্রী মনোযোগ সহকারে শোনলেন এবং নোট করলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ৯৬ইং হতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলে যোগদানের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। তখন ব্যক্তিগতভাবে আমি বিষয়টি খুব নেগেটিভ ভাবে নিয়েছিলাম এবং যখনই সুযোগ পেতাম সিনিয়র ও জুনিয়র নেত্রীবৃন্দের সাথে আলাপ করতাম। আমি বিশ্বাস করতাম আদর্শহীন লোক ও সুবিধাবাদীরা দলের ও জনগণের প্রয়োজনে পালিয়ে যায়। এরা শুধুমাত্র যোগদান করে নিজের অপকর্ম ও পকেট ভারী করার জন্য।
সেদিন গণভবনে নেত্রীর সামনে বলেছিলাম, মাননীয় নেত্রী আপনি তৃণমূলের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত কর্মীদের সাথে নিয়ে স্বৈরাচার এরশাদ ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। তাই আমার প্রশ্ন কেন আজকে আপনার বিশ্বস্ত কর্মীদের সাথে সুবিধাবাদীকে স্থান দিতে হবে? আমি বলেছিলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিষ্ঠা করতে আজীবন আপনার নেতৃত্বে জীবন উৎসর্গ করবো।
সকল জেলার নেত্রীবৃন্দের বক্তব্য শোনার পর নেত্রী বলেছিলেন, কেন নতুন করে যোগদানের প্রয়োজন হল। আমরাতো আমাদের পরীক্ষীত ত্যাগী কর্মীদের সাথে নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম করে জনগণের ম্যাণ্ডেড নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। আমার কর্মীরা কানা, ল্যাংড়া, আতুর হলেও তাঁরা আমার প্রাণ। সংগঠনের প্রাণ যাঁরা, বিভিন্ন সময় জীবন দিয়ে আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়েছে তাঁরা। সেদিন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য আমাদের মনে প্রাণচঞ্চল্যতা এনে দিয়েছিল। দলে সুবিধাবাদী ও উড়ে এসে জুড়ে বসাদের দ্বারা পরীক্ষীত ত্যাগী কর্মীরা কোণঠাসা হবেন না ও তাঁরা সব সময় মূল্যায়িত হবেন এই বিশ্বাস আমার মত সবার মনে জন্মেছিল। নতুন উদ্দীপনা আমাদের মনে জাগ্রত হয়েছিল।
সভা শেষে নেত্রীর এপিএস রবিউল ভাই আমাকে দুই হাজার টাকা দিয়ে বললেন, তুমি সিলেট থেকে এসেছ। তোমার বক্তব্য ভালো হয়েছে। নেত্রীর পক্ষ থেকে তোমার পুরস্কার। সেদিন এই দুই হাজার টাকার পুরস্কার ছিল আমার ছাত্র রাজনীতির স্বার্থকতা। এক পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। এটা ছিল নেত্রীর কাছ থেকে আমার পরম পাওয়া। আমি আমার প্রাণপ্রিয় নেত্রীর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ।
এদিকে, সন্ধ্যার কোন এক ফাঁকে তখনকার সিলেট জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক শাহ্ শামীম আহমদ ঢাকা থেকে ফ্যাক্স যোগে সিলেটের সব পত্রিকার নিউজটি পাঠিয়ে দিলেন এবং সিলেটের স্থানীয় সবকটি পত্রিকা গুরুত্ব সহকারে খবরটি ছাপিয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সিলেট জেলা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ শিরোনামে নিউজটি ছাপা হয়েছিল।
সন্ধ্যারপর ক্যাপিটেল হোটেলে ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মী মিলে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় তখনকার সময়ের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমাদের নেতা সুলতান মোঃ মনসুর আসলেন এবং আমাকে দেখার সাথে সাথে বললেন – কিরে শাহজাহান কি বক্তব্য দিয়েছিস, আমি সব খবর পেয়েছি, পকেট তো খুব গরম। এখন সবাইকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর। সবাই মিলে চা চক্র ও কোমল পানীয় পান করলাম। বেশ জমিয়ে আড্ডা হলো।
স্মৃতিমূলক এ লেখার পরিশেষে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মাননীয় নেত্রীকে বলতে চাই, দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল অনেক ভাল। আদর্শহীন কর্মী দিয়ে কখনো কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর যে কোন অজানা বিপদ সামনে আসলে সুবিধাবাদী চাটুকাররা তাদের আপন ঠিকানায় পালিয়ে যায়। তাই
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান দিতে আপনার দুঃস্বসময়ের ত্যাগী কর্মিদের খোঁজে দলের ভিতরে ও সরকারে মূল্যায়ন করুণ। আপনার হাত আরও বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী হবে। জয়বাংলা।
লেখক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য