নজমুল কবিরঃ বিডি বস, প্যারিস বিতাড়িত। বিতাড়িত পুরুষের জামাকাপড়, প্রসাধন সামগ্রী। শুধু দখল বললেও হয় না। নতুন নাম ‘পিংক সিটি’। মেয়েদের পোষাক, শিশুদের পোষাক। প্রসাধন সামগ্রী। ভেতরে বাইরে পিংক রংয়ের ছোঁয়া। থরে থরে সাজানো মহিলাদের পোষাক, অলংকারসহ অন্যান্য সামগ্রী। মাস কয়েক আগেও যারা প্যারিস গার দু লিস্টর এই বিডিবসে এসেছেন তারা এখন এই শো-রুমে ঢুলকে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খাবেন। পুরুষদের কোন আইটেম আর চোখে পড়বে না।
বিডিবস প্যারিসের এই আমুল বদলে দেয়ার যৌথ উদ্যোগ দুজন স্বপ্নবাজ তরুন ব্যবসায়ী। মাসুদ মিয়া আর আয়ুব হাসান। দু’জনের দু’ধরনের ব্যবসা। আয়ুব হাসান প্যারিসের উপকন্ঠ সার্সেল শহরে বিডিবস নামের একটি জেন্টস শো-রুম রয়েছে। বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেটি। আর মিয়া মাসুদের রয়েছে ফার্নিচারের ব্যবসা বিডি মুব্ল নামে। এই প্রতিষ্ঠানটিও অল্প সময়ের মধ্যে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এবারে এই দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সফল মালিক যৌথভাবে গড়ে তুলেছেন ‘পিংক সিটি’ নামে অন্য এক প্রতিষ্ঠান। মহিলা এবং শিশুদের পোষাক ও প্রসাধনীর নানা পণ্য পাওয়া যাবে এখানে।
বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর উপস্থিতিতে উদ্বোধন করা হলো পিংক সিটি। কয়েকদিনের ব্যবধানে ইতোমধ্যেই সরগরম হয়ে উঠেছে পিংক সিটি। এখানে কর্মরত সকলেই নারী। তাদেরকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে পিংক সিটি মালিকদ্বয়।
এই উদ্যোগের বিভিন্ন দিক নিয়ে ‘ফ্রান্স দর্পন’ পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে কথা বলেছেন মাসুদ মিয়া এবং আয়ুব হাসান।
মাসুদ মিয়াঃ
ফ্রান্সে বাংলাদেশের সবাই জানে যে, আমি ফার্নিচার ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। বিডি ফার্নিচার ওভারভিলিয়েহ নামে আমার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। তো আমাদের এখানে আসা কাস্টমাররা অনুভূতি প্রকাশ করে বলে যে, তারা সঠিক মান, দাম এবং চাহিদা অনুযায়ী পাচ্ছে। কিন্তু পছন্দের কাপড়চোপড় এখনও হাতের কাছে পাচ্ছে না, কুরিয়ারের মাধ্যমে আনতে হয়। এখানে অনকেকেই অনলাইন বিজনেস করতেছে। তাদের মাধ্যমে কিছু চাহিদা মিটছে। কিন্তু তারাও হয়তো জানেনা কোন ধরনের কাপড় বা ডিজাইন আসতেছে।
আমরা জানি যে, যারা অনলাইন বিজনেস করেন তাদের কাপড়গুলো ইন্ডিয়া, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে পণ্য প্রথমে লন্ডনে, তারপর প্যারিস। ফলে কস্ট বেশি পড়ে। আমরা প্লান করছি, এদেশে অনলাইনে পোষাক বিক্রেতাদের সরাসরি ইন্ডিয়া, পাকিস্তান থেকে এনে তাদের হাতে তুলে দিতে। তাতে করে ভাল মান এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পোষাক পাবে। থ্রী পিস, ল্যাহেঙ্গা সহ বিভিন্ন পোষাক সরাসরি ফ্রান্সে আনার একটা প্রয়াস থাকবে আমাদের এই পিংক সিটির উদ্যোগের মাধ্যমে।
আমরা একটি চ্যালেঞ্জ নিয়েছি ক্রেতাদের হাতে ভাল মান, ভাল সার্ভিস এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্যটি পৌঁছে দিতে। আর এটি নিশ্চিত করতে পারলে কাস্টমার আসবেই।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কাস্টমারদের কাস্টমার হিসেবে দেখি না। তাদের দেখি পরিবারের সদস্য হিসেবে।
আমাদের এখানে আর একটি নতুন দিক শুরু করছি তা হলো, এখানে যারা সার্ভিস দেবেন তারা সকলেই নারী। এর কারন নারীরা নারীদের পছন্দ, অপছন্দ শেয়ার করবে। এটি বাস্তবতা যে, একজন নারী ক্রেতা যখন একটি পোষাক কিনতে যায়, সেখানে পুরুষরা থাকলে পোষাকের প্রাসঙ্গিক আলোচনাগুলো খোলামেলাভাবে করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। এই উপলব্ধি থেকে আমরা পিংক সিটির সার্ভিস দেয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের নিয়োগ দিয়েছি। এতে তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হলো, স্বাবলম্বী হবার একটা পথ তৈরি হলো।
আমরা আমাদের কমিউনিটির কথা চিন্তা করে ৩ কিস্তিতে পোষাক দেয়ার একটি সুবিধার কথা বিবেচনা করছি। আমরা চাচ্ছি সহজ প্রক্রিয়ায় পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দিতে।
আয়ুব হাসানঃ
আসলে আমার দুটো প্রতিষ্ঠান বিডিবস সার্সেল এবং প্যারিস – দুটোই ছিলো জেন্টস কালকেশন। দুটোই জেন্টস শো-রুম হয়ে গেছে। কিন্তু প্যারিসে আমাদের কমিউনিটি অনেক বড় হয়েছে, এখনও বাড়ছে। তো একটা চিন্তা মাথায় আসলো জেন্টসদের প্রয়োজন মেটাতে একটি সার্সেলে যেহেতু আছে, প্যারিসের টা লেডিসদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য আয়োজন করাটা ভাল হবে। সেই উপলব্ধি থেকে আমি এবং আমার বন্ধু মাসুদ মিয়া যৌথ উদ্যোগে এটি শুরু করলাম।
অনেক ক্লায়েন্ট আছে যারা পোষাক কেনার জন্য বিডিবসে আসে। তারা নিজ থেকেই বলে জেন্টসদের শো-রুম আছে, একটা লেডিস শো-রুম হওয়া দরকার। তাদের দীর্ঘদিনের একটা প্রত্যাশা প্যারিসে একটা লেডিস শো-রুম প্রয়োজন। প্যারিসে লেডিস শো-রুম হলে ব্যাপক চাহিদা মেটানো সহজ হবে। সেই জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। প্যারিসে এসে গ্রাহকরা বাচ্চা-কাচ্চা, পিতা-মাতা একসাথে এসে যেন স্বচ্ছন্দে কেনাকাটা করতে পারে সেজন্য এ উদ্যোগ।
প্যারিসে বাংলাদেশ কমিউনিটি ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিন্তু বর আকারে শো-রুম নেই বললেই চলে। আমরা বলতে পারি বৃহত্তর উদ্যোগের দিক থেকে বাংলাদেশীদের পোষাক-চাহিদা মেটানোর জন্য বিডিবসই প্রথম এবং সেট জেন্টসদের। এবারে প্যারিসে আপনাদের আরো কাছপ, হাতের নাগালেই আমরা উপস্থিত হয়েছি পিংক সিটির মাধ্যমে। আমরা আশা করি বিডিবস যেমন সবাই গ্রহণ করেছে, প্যারিসের পিংক সিটিও সেভাবে, বরং আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে আমাদের আপু এবং বাচ্চাদের কাছে।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশীদের মাঝে পাকিস্তানী পোষাকের বিপুল চাহিদা। আমরা যখন ভাল কিছু চাই তখন দেখি আসলে পোষাকের ক্ষেত্রে কোন্ ধরনের ট্রেন্ড চলে। সেক্ষেত্রে কখনও ইন্ডিয়ান, কখনও পাকিস্তানী পোষাকের প্রতি ভোক্তাদের ঝোক। তো এমুহূর্তে আমরা লক্ষ্য করছি, পাকিস্তানী পোষাকের দিকে ভোক্তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা ঠিক সেটাতেই ফোকাস করছি। যার কারনে এখানে দেখবেন আমার ম্যাক্সিমাম কালেকশন পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করা।
আমরা আরো এখানে যুক্ত করেছি বাংলাদেশী জামদানী শাড়ী, সুতি থ্রিপিস এখানে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, আফগানিস্তান – এই ৩ দেশ থেকেই আমরা প্রোডাক্ট সংগ্রহ করছি। এদেশে আগত দক্ষিন এশীয় দেশের মানুষের চাহিদাকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শো-রুম সাজিয়েছি।
প্যারিসে আমরা বসবাস করলেও আমাদের আচরণগত কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক মহিলা আছেন যারা কেনাকাটা করতে গিয়ে ইভ টিজিং বা অবাঞ্ছিত আচরণের শিকার হন। সেদিকটি বিবেচনায় রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেলস পার্সন হিসেবে মেয়েরা কাজ করবে। এর ফলে সাচ্ছন্দ্যে তারা তাদের কাঙ্খিত পোষাক তথা অন্যান্য কেনাকাটা করতে পারবে।
তওফিকা শাহেদঃ (নারী নেত্রী)
বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি শক্তিশালী কমিউনিটির একটি বৈশিষ্ট্যের ধারনা দেয়। আমি বলবো, ‘হর্স পাওয়ার’ এর শক্তি নিয়ে প্রবল গতিতে আমাদের কমিউনিটি এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা গত ১০ বছর আগে শুনতাম অমুক যায়গায় একটি বাংলাদেশী দোকান হয়েছে। এখন এখন প্রায় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার কবর পাচ্ছি।
আমি আমার পক্ষ থেকে এবং বিকশিত নারীর পক্ষ থেকে জানাচ্ছি ‘লাল সালাম’। লাল সালাম একারনে, এই পিংক সিটিতে যারা কাজ করছে তারা সবাই নারী। এটা প্যারিসে প্রথম এবং এমন উদ্যোগ নেয়ার জন্য পিংক সিটির স্বত্বাধিকারীদের ধন্যবাদ।
আমাদের ভাল লাগছে একারনে এখানে বাংলাদেশী বোনেরা কাজ করতে পারছে। আমাদের পক্ষ থেকে এই অনুরোধ থাকবে, বাংলাদেশী যারা উদ্যোক্তা আছেন তারা বাংলাদেশী নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে।
প্রতিটা মানুষেরই কিছু না কিছু গুণ আছে। সেই গুণের বিকাশ ঘটাতে এবং সুযোগ তৈরি করতে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা মাসুদ মিয়া আয়ুব হাসানের মত এগিয়ে আসবেন। স্বামীর পাশাপাশি নিজে কিছু করে পরিবারে ভূমিকা রাখতে পারে এমন পরিবেশ তৈরি করতে সবাই এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছি।
ফারুক হোসেন, (ব্যবসায়ী এবং কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব)
পিংক সিটি একটি বড় আয়োজন নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। বাংলাদেশ কমিউনিটি বিবেচনায় এটি নারী এবং শিশুদের পোষাক পণ্যের বিপুল সংগ্রহ নিয়ে শুরু করেছে, এটি প্যারিসে উদ্যোগের দিক থেকে নতুন এবং আকারে অনেক বড়।
চমৎকার করে সাজানো এবং গোছানো, দেখলেই মন ভরে যায়। মহিলাদের সাথে বাচ্চাদের কম্বাইন্ড এই কালেকশন পরিবারের সদস্যদের পছন্দ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বেবীরা মায়েদের সাথে শপিং করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। পিংক সিটির উদ্যোক্তারা এমন একটি চিন্তা মাথায় রেখে শো-রুমটি সাজিয়েছেন যা দেখতে ভাল লাগছে।
শুরুতেই আশংকার কথা লিখেছিলাম যে, পিংক সিটি এসে বিডি বসকে হটিয়ে দিয়েছে। ফলে বিতাড়িত হয়েছে পুরুষ! কিন্তু দুই মালিক, আয়ুব হাসান এবং মাসুদ মিয়া আশ্বস্ত করেছেন যে, এখানে কিছু আইটেম পাওয়া যাবে পুরুষদের, বিশেষতঃ পাঞ্জাবি। যাক, কোন রকম অস্তিত্ব রক্ষা হলো বৈ কী!