সাব্বির হাসান রসি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ফ্রান্সের গ্রোনব্ল শহর থেকে এসেছেন প্যারিসে, সপরিবারে। তার ছোট্ট রাজকন্যার হাতে প্লাকার্ড! তাতে ইংরেজীতে লেখা, ‘সেভ স্টুডেন্টস, সেভ বাংলাদেশ।’ প্রতিবাদের প্রতীক। এমন আকুতি বয়ে নিয়ে এসেছে। শিশুটি এসেছে প্যারিসের রিপাবলিক চত্তরে আজ বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিতে।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফরাসী শাহীন মাহমুদ এর ৩ ছেলে-মেয়ে এসেছে সমাবেশে অংশ নিতে। তারা তিনজনই ফরাসী নাগরিক। নিজস্ব হাতে লেখা উদৃতি, ‘বাংলাদেশ ডিজার্ভ ইকুয়ালিটি, নো কোটা ফর ডিগনিটি।’
বাংলাদেশী স্টুডেন্টস ফোরাম, ফ্রান্স নামের একটি গ্রুপ যারা বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে পড়াশুনা করতে এসেছে। চাকুরীতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়। প্যারিসের বিখ্যাত রিপাবলিক চত্বরে সমাবেশ আয়োজনের অনুমতি পাবার পর বিসিএফ (বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফ্রান্স) সংস্থার মাধ্যমে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হয়। আয়োজনের ছায়াসংগীর ভূমিকা গ্রহণ করে সামাজিক সংস্থা বিসিএফ। পাশাপাশি স্টুডেন্টস ফোরামের সদস্যরা সমাবেশে যোগদান করার আহবান করা হয়।
ইতোমধ্যে আগুনের ফুলকির মত ছড়িয়ে পড়ে অনুষ্ঠানের খবর। বাংলাদেশের চলমান কোটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক পুলিশী আক্রমন এবং শতাধিক শিক্ষার্থীকে হত্যা করার ফলে এই আন্দোলন কেবল কোটা সংস্কারের আন্দোলনে থেমে থাকেনি। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো লাল-সবুজ মানচিত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতির সামাল দিতে ব্যর্থ হবার প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী তলব এবং কারফিউ জারি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে চলমান পরিস্থিতির উত্তেজনার পারদ বাড়াচ্ছে, এমন প্রতীতি জন্মানোর ফলে ক্ষমতাসীন সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপি সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে বাংলাদেশ পরিস্থিতি। বিশ্বের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশের এমন অরাজক পরিস্থিতিতে স্থির থাকতে পারেনা, পারেনি।
বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে তাই বিক্ষোভের ডাক আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তা পৌঁছে যায় সর্বত্র। প্যারিস শহরও এমন বিপন্ন ঢেউয়ে কেঁপে ওঠে, বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এমন নিষ্ঠুরতায় ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশের মানুষ কী করে চুপ থাকে। কেন ডাক আসছে না একটি বিক্ষোভ সমাবেশের! কমিউনিটির নেতারা কী ঘুমায়! এমন অভিযোগ আসতে থাকে। ইতোমধ্যে নানা দিক থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজনের কর্মসূচির ঘোষণা আসতে থাকে।
অবশেষে এলো! মাত্র ২ দিনের নোটিশে শনিবার (২০ জুলাই) প্যারিসের বিখ্যাত রিপাবলিক চত্বরে নির্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই দলে দলে যোগদান করতে আসা শুরু হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনোরকম মিছিল-শ্লোগান করা যাবে না – এমন বিধিনিষেধ থাকা সত্বেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের নিবৃত্ত করার সাহস হয়নি।
বিশ্বব্যাপী ইতিহাসে শিক্ষার্থীরাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, জীবন দিয়েছে। তাদের আত্মাহুতির পথ ধরেই সাফল্য এসেছে। ইতিহাসের গতিপথ তৈরি করেছে, বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এমন বদলে দেয়ার ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিরত্বের নিজস্বতার স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। চলমান আন্দোলন তেমনই মহিমায় ভাস্বর।
প্যারিসের রিপাবলিক চত্বরে এমন জনসমাবেশ দেখে ফরাসী এবং অন্যান্য বিদেশীদের বিস্ময়মাখা চাহনী। উৎসুক প্রশ্ন। অনেক বাংলদেশীকেই দেখা গেছে এর ব্যাখ্যা দিতে।
বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনের খুব কমই জানা যাচ্ছে। কেননা যোগাযোগ মাধ্যম সরকার বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা উর্ধমুখী হচ্ছে। চলমান এই আন্দোলনে নিহত থোকা থোকা শোকার্ত নামগুলো! প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়। স্বজন হারানো মা-বাবা আত্মীয়জনদের বিদীর্ণ করা হাহাকার অন্তরের ভেতরটি কাঁপিয়ে দেয়। অন্যদিকে শাসকদের চলনে-বলনে প্রতীয়মান হয়, এ যেন কোনো ব্যাপারই নয়!
এমন বিপন্ন সময়ে প্রবাসীরা বড্ড অসহায়। লাল-সবুজ মানচিত্রে ক্রমশঃ সবুজ ঢেকে যাচ্ছে হত্যার রক্তে! লাল বিস্তৃতি লাভ করছে। অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে রাজনীতি, অর্থনীতি। এমন অবস্থায় বিক্ষোভ ছাড়া করবার কী আছে। প্রবাসী বাংলাদেশীর প্রতিটি পরিবার আর মেসে বসবাস করা ব্যাচেলরদের হাতে তৈরি হচ্ছে ফেস্টুন। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রতিরোধের ঢেউ উথলে উঠছে। খন্ড খন্ড সেই ঢেউ এসে চূড়ান্তভাবে আছড়ে পড়েছে রিপাবলিক চত্বরে। লোকে লোকারণ্য। আবালবৃদ্ধবনিতা, একমঞ্চে, এক কাতারে, একই লক্ষ্যে সমবেত। বাংলাদেশে এই সর্বনাশা খেলা বন্ধ হোক।
উপস্থিত মানুষের বিক্ষোভ, শারীরিক ভাষা দেশের প্রতি তাঁদের দরদের গভীরতা প্রকাশ করে। রাজনৈতিক মতাদর্শে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হলেও অধিকাংশ সাধারণ মানুষ। কিন্তু তারাও বেশ বিক্ষুব্ধ সেটি বোঝা যায়।
অন্যায়হীন, দুর্নীতিহীন এবং পরিশীলিত রাজনৈতিক চর্চার উদার ভূমি হয়ে উঠুক বাংলাদেশ। এতটুকু চাওয়া, আর কিছু নয়। প্যারিসের রিপাবলিক চত্বর সাময়িক দখলে নেয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের এই চাওয়াটুকু লাল-সবুজ মানচিত্রের।
স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হয়ে গেলো! এখনও এই সহজ চাওয়াটুকুর বাস্তবায়ন দেখছে কী বাংলাদেশ।