আমাদের অনেকের জানা না থাকলেও, আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীর ঘরে কিন্তু আগুন লেগেছে। গত কয়েকদিন ধরে নাগরিকদের ক্ষোভে স্থবির হয়ে আছে বাংলাদেশ। যারা ভারতের আস্থাভাজন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে এভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে, তারা কিন্তু জামায়াতের মোল্লা বা পাকিস্তান-প্রিয় খালেদা জিয়ার বিএনপি নয়।
ছোট ছোট স্কুলশিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছে একটি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে হাসিনা সরকারের ঔদ্ধত্য ও একগুঁয়েমির প্রতিবাদে। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত দুই স্কুলশিক্ষার্থী নিহত হয় এক মন্ত্রীর আত্মীয়ের বাসের নিচে চাপা পড়ে। এমন দুঃখজনক ঘটনা ওই মন্ত্রী হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সরকারের চাপে মৌন গণমাধ্যম পর্যন্ত ভয়াবহ সব ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, পুলিশ ও ছাত্রলীগের (আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন) কর্মীরা নির্দয়ভাবে শিশুদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। তাদের চুল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
এই ধরপাকড়ে শ’ শ’ শিশু আহত হয়েছে। মৃত্যু নিয়েও জল্পনা রয়েছে। ওই মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলার বদলে, রাষ্ট্রযন্ত্র কিশোরদের ওপর আরো বেপরোয়া নির্যাতন কায়েম করেছে। সঙ্গে ছিল ফাঁপা জনসংযোগ (পাবলিক রিলেশন্স) চেষ্টা। ক্রিকেট অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের মতো অনেক প্রখ্যাত নাগরিককে এই প্রচেষ্টায় যুক্ত করে শিশুদের প্রতিবাদ বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষের ক্ষোভ ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কারণে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার খবরও আছে। ফলাফল কী হলো? আরো বেশি শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরাও।
স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই ধরনের পাষাণ আচরণ দুনিয়ার ন্যায়নীতির বালাইহীন কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও নজিরবিহীন। আর হাসিনা ভবিষ্যৎ ভোটারদের গোটা এক প্রজন্মকেই শত্রুভাবাপন্ন করে তোলার ঝুঁকিতে আছেন।
এই ক্ষোভ কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। তিক্ত দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে যেমন দৃশ্যত ছোট ছোট কারণ থেকে, তেমনে এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের চরমসীমা।
হাসিনা সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে। শিশু আন্দোলনের আগে থেকেই সরকারের প্রতি জনসমর্থনের হার (অ্যাপ্রুভাল রেটিং) ২০ শতাংশেরও কম বলে জানায় ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলো।
সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো চিন্তা ছাড়াই এক দশক নির্বিঘেœ পার করার পর সরকার দৃশ্যত দুর্নীতি ও আত্মতুষ্টির কাদায় ডুবে গেছে। প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ আমলাতান্ত্রিক কাজে লাগামহীন দুর্নীতির বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে। কিছু ক্ষেত্রে ঘুষের হার ৩০ শতাংশের মতো। আর ভারতীয় সূত্রগুলো বলছে, শাসক পরিবারের একটি অংশের বেছে নেয়া সহযোগীরা সর্বোচ্চ স্তর থেকে এসব নিয়ন্ত্রণ করছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির সূচকে ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৪৩ স্থানে রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক সুশাসন সূচকে দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশ ১০০-তে ২০.৬ নম্বর পেয়েছে।
বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঋণ আর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের দেয়া ঘুষে রাষ্ট্রযন্ত্র ভেসে গেছে। এসবের পরিণতি কী হয় শ্রীলঙ্কা কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। দেশটি এখন রাজস্বের বিরাট অংশ সুদ দিচ্ছে চীনকে। চীনের এ ধরনের ঋণ পাকিস্তানকে কার্যত দেশটির কলোনিতে পরিণত করেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হাসিনা সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। হলি আর্টিজান বেকারি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকে জামায়াতের কাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে কট্টরপন্থি হেফাজতে ইসলামকে প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করা আর জামাতের সঙ্গে গোপন সখ্য এসব সাফল্যকে নষ্ট করেছে।
হাসিনার আমলেই শ’শ’ হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু হত্যা, আক্রমণ, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ, ভিটা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন প্রতি বছর। এসবের পেছনে প্রায়ই আওয়ামী লীগেরই সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকে।
বাংলাদেশে ভারতকে ক্রমেই এমন শক্তি হিসেবে ভাবা হচ্ছে যেটি কিনা হাসিনার সরকারকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে। মানুষের আশঙ্কা হলো শাসকগোষ্ঠীর ঔদ্ধত্যের নেপথ্যে এই বিষয়টিই রয়েছে যে ভারত নিজের শক্তি ও অর্থ দিয়ে আগামী নির্বাচনগুলোতেও জনরোষ থেকে দলটিকে রক্ষা করবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, হাসিনা সরকার যতই জনসমর্থন হারাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইমেজও বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষুণœ হচ্ছে।
ভারতের জন্য এটি কি সহনীয় কিছু? একটি ভীষণ অজনপ্রিয় শাসকগোষ্ঠীকেÑ যেটিকে কিনা এখন শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা করতে দেখা যাচ্ছেÑ সেটিকে প্রশ্নহীন সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য কেবল পাকিস্তানপন্থি বিএনপি ও জামাতের জুজুই কি যথেষ্ট?
প্রশ্নহীনভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও অসুস্থ ও বার্ধক্যগ্রস্ত খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোটাও শাসক দলের পক্ষে যায়নি। কারণ, মানুষ তাকে এখন সহানুভূতির চোখে দেখছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ঢাকায় আমাদের সবচেয়ে বড় মিত্রটি আসলে কতটা অঙ্গীকারাবদ্ধ? ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকদিন ধরেই হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ থাকার ব্যাপারে সতর্ক করে আসছে। তবে এতে তেমন সাড়া মিলেনি।
ভারতের উদ্বেগ সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো ও রাজনীতিতে চীনের অর্থের প্রবাহ কমেনি এতটুকু। তবে সম্ভবত শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে কুটিল বিশ্বাসঘাতকতা হলো জামায়াত, ইসলামী মৌলবাদ ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিয়ে ডাবল-গেম খেলা। ফলে খুব ধীরে হলেও দৃশ্যমান হচ্ছে অস্বস্তিকর একটি চিত্র।
জানুয়ারিতে স্থানীয় পত্রিকাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট নামে একটি সংখ্যালঘু অধিকার গোষ্ঠী জানিয়েছে, ২০১৭ সালে ১০৭ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। ৩১ জন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে। ২৩৫টি মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়েছে। ২০১৬ সালের চেয়েও এই সংখ্যা অনেক বেশি। ওই বছর ৯৮ জনকে হত্যা ও ১৪১টি মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব হামলার বেশিরভাগেই সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ সদস্যদের বিরুদ্ধে।
জামায়াতের বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানোয় প্রশংসার যোগ্য হাসিনা সরকার। তবে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদির মৃত্যুদ- রহস্যজনকভাবে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি কারাগার থেকে জামায়াতের কর্মকা- পরিচালনা করছেন।
সাম্প্রতিক সিলেট সিটি নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে লড়েছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরোক্ষ বোঝাপড়ার মাধ্যমেই জামায়াতের এক নেতা প্রার্থী হন। যাতে করে ভোট তিনভাগে ভাগ হয়ে বিএনপি পরাজিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য বলা হচ্ছে, নির্বাচন শুরুর আগেই প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি ভুয়া ভোট দেয়া ছিল। এরপরও বিএনপি প্রার্থী জিতে যায়। এতটাই তলানিতে ঠেকেছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা।
মার্চে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনেও ব্যাপকভাবে জয়ী হন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা। সামনের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি যাতে জামায়াতের আন্ডারগ্রাউন্ড সমর্থন না পায়, সেজন্য কি হাসিনা জামায়াতকে সাধারণ অবস্থায় ফিরতে দিচ্ছেন?
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। ঢাকায় অস্থিতিশীল ও খুবই অজনপ্রিয় সরকার টিকিয়ে রাখার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, ভারতের সামনে বিকল্পও খুব কম।
পাকিস্তান প্রীতি বিএনপির ডিএনএতে আছে। জিয়ার নির্বাসিত ছেলে তারেক রহমান হয়তো ভারতের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ চ্যানেল তৈরি করতে চান। তার মায়ের পুরোনো রাজনীতি সহসাই নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে এমন সম্ভাবনা কম। সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ভাবা হয় আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে। এরশাদ বয়স্ক। নেই তার সুস্পষ্ট উত্তরসূরি রেখে যাওয়ার পরিকল্পনা। ফলে তার ওপর দীর্ঘমেয়াদে বাজি ধরতে ভারত দু’বার ভাববে।
সকল উদ্বেগ সত্ত্বেও ভারত সব সময় চেয়ে এসেছে হাসিনা সফল হোন। কিন্তু এখন সেটা দূরকল্প মনে হচ্ছে। নব ভারতের উদয় হয়েছে গণআন্দোলন এবং দুর্নীতি ও বংশীয় অভিজাতদের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে। এভাবেই জাতীয় রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটেছে মোদি ও অরভিন্দ কেজরিওয়ালের মতো নেতাদের। তারা পেরেছেন জনমানসকে ধারণ করতে। নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে দাবি করেছেন দেশপ্রেম, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
বাংলাদেশও হয়তো সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি। একটি নতুন, মেধাভিত্তিক ও দেশপ্রেমী ভারতের প্রতিনিধি যেই মোদি, সেই তিনি হয়তো বাংলাদেশে আমাদের প্রভাবকে ব্যবহার করে একটি নতুন নেতৃত্বের উত্থানে সহায়তা করতে পারবেন। পেছনে থেকে যাবে বিবদমান পরিবারতন্ত্র ও এর ফলভোগী দুর্নীতিগ্রস্ত এলিটরা।
এই উত্তাল সময়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা বাইরে থেকে হয়তো সম্পূর্ণ আনকোরা ও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন নতুন নেতার আবির্ভাব হতে পারে। এখনই ভারতের গোয়েন্দাদের নিজেদের ঘ্রাণ শোঁকার ক্ষমতা সর্বোচ্চ ব্যবহার করার সময়। যাতে করে ভারতের নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ নেতাদের চিহ্নিত করতে পারে ও বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা দিতে পারে।
(অভিজিৎ মজুমদার ভারতের মাইনেশন.কম নামে একটি ডানঘেঁষা সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটের সম্পাদক। এটি মাইনেশন.কমে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ।)