নজমুল কবিরঃ ফ্রান্সে বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতি চর্চার কোনো পরিশীলিত এবং নান্দনিক প্রয়াস থাকলে তার সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদার ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফ্রান্স সংসদ’ এর। রোববার (২১শে মে) বাংলা নববর্ষ উৎসব-১৪৩০ আয়োজনে তারা তাদের পারফরম্যান্স এর চমৎকার মুন্সীয়ানায় সেটি প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশী তো বটেই, অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীও এই মুগ্ধতা ছড়ানো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালীয়ানার ছোঁয়া পেয়েছে। কী, নাচ, কী, গান কিম্বা আবৃত্তি – সবকিছুতেই নিরন্তর চর্চা প্রয়োজন। আর সেই চর্চাকে সমবেত মানুষের সামনে পারফর্ম করা এতো সহজ কাজ নয়। প্রবাসজীবনের নানা সীমাবদ্ধতার ভেতরও শিল্পীদের পারফরম্যান্স, পরিধেয় পোষাকের বিন্যাস, মেকআপ – সমস্ত কিছুর ভেতরই একেবারে খাটি বাঙালীয়ানার ছোঁয়া। এমন চমৎকার আয়োজন কার না মন ছুঁয়ে যায়!
সময়ের পরিক্রমায় এদেশে অসংখ্য পরিবার তাদের স্থায়ী আবাস গেড়েছে। অনেক শিশু-কিশোরের জন্ম এদেশেই। তাদের মূল ভাষা স্বাভাবিক কারনেই ফরাসী। কিন্তু এদেশের স্কুল কলেজ থেকে শিক্ষকরা শিক্ষায়তনের বাইরে পারিবারিক পরিমন্ডলে অবশ্যই তাদের নিজ দেশের ভাষায় কথা বলতে নির্দেশনা দান করে। সেই নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেক অভিভাবক তার শিশুদের একটি ভাষা শেখা থেকে বঞ্চিত করে। বরং অনেক পরিবারের অভিভাবকদের গর্ব করে বলতে শোনা যায়, ‘জানেন আমার ছেলে-মেয়েরা একদম বাংলা বলতে পারে না।’ এমন সর্বনাশা গর্বিত বাবা মা বরং একটি শিশুর মুখ থেকে তার শেকড়-পরিচয়ের মূল ভাষাটি কেড়ে নিয়েছে। এমন শেকড়-বিচ্ছিন্ন সন্তান গড়ে তোলার পেছনে এই অভিভাবকরা ভূমিকা রেখে চলেছেন।
অন্যদিকে অবাক বিস্ময়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফ্রান্স সংসদ এর নিরবচ্ছিন্ন চর্চার ছায়াতলে একঝাঁক শিশু-কিশোর-কিশোরী বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলায় গান গায়! বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে! বাংলা গানের সাথে নাচের নানা মূদ্রায় নিজেদের তুলে ধরছে এক নিখুঁত নৃত্য শিল্পী হিসেবে! বিদেশ-বিভুঁইয়ে এমন সাংস্কৃতিক চর্চার একক ও দলীয় প্রদর্শনী সত্যি অবাক করবার মত। প্যারিসে খোদ নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মাধ্যমে নিজেদের পারফরম্যান্সের মুন্সীয়ানার কৃতিত্ব এককভাবে দেয়া যায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট সকলকে। ফ্রান্সে সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তুলে ধরার এই উদ্যোগের কৃতিত্ব তাদেরকেই দিতে হয়।
ছোট ছোট শিশুদের মুখে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার রায়ের শিশুতোষ ছড়া, কবিতা শুনে কার না মন বিমুগ্ধতায় বিগলিত হয়! বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে যায় একারনে যে, এই শিশু-কিশোরদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এদেশেই, এই ফ্রান্সে। অথচ নিরবচ্ছিন্ন চর্চা এবং সাধনার মাধ্যমে এই শিশুরা তাদের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার রায়, জসীমউদ্দিনকে ধারন করছে। এটি অতি গর্বের।
যারা এদেশে জন্মে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকুমার-জসীমউদ্দীনকে চেনা তো দূরের কথা বিকৃত উচ্চারণেও বাংলা বলতে পারে না তাদের জন্য এই শিশুরা একটি ‘বিস্ময়’ বৈ কী! বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফ্রান্স সংসদ এই প্রয়াসটিই চালিয়ে যাচ্ছেন নীরবে, নৈপুণ্যের সাথে।
রাজধানী প্যারিস শহর লাগোয়া ওভারভিলিয়েহ, লা কর্নোভ, পন্তা, সেইন্ট ডেনিস শহরসমূহ তাবৎ পৃথিবী থেকে আসা অভিবাসীদের শহর। এখানে শতাধিক ভাষা-ভাষী মানুষের বসবাস। ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা এ শহরগুলোকে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি চর্চার একটি চমৎকার কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চাটিও তারই গর্বিত অংশীদার। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বৈচিত্র্যময় সেই সাংস্কৃতিক বন্ধনে ‘বাঙালীয়ানা’কে অবিচ্ছিন্ন অংশ রূপে স্থান করে নিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে।
‘বাংলা নববর্ষ উৎসব -১৪৩০’ ছোটমনিরা যেমন করে আবৃত্তি করলো, গান গাইলো, নৃত্য পরিবেশন করলো, নাট্যাংশে অভিনয় করলো – তা উপস্থিত সকলের বিস্ময়ের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা আর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি দরদ না থাকলে এমনটি অসম্ভব।
উদীচীর অনুষ্ঠানকে ঘিরে অনেককেই বাঙালীর পোষাক শাড়ি এবং পাঞ্জাবি পড়তে দেখা গেছে। বাঙালী খাবার যেমন, পিঠা-পুলি, বিরিয়ানী, সিংগারা, সমুচা, পাকোডা, চটপটি, ফুচকা খেতে দেখা গেছে অনেককেই। শাড়ি, সালোয়ারের পোষাক, গহনার পসার – কী ছিলো না অনুষ্ঠানে?
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফ্রান্স সংসদের এই শিল্পীদের নিয়ে কেন বড় বড় অনুষ্ঠান করা হয় না? কেন তাদের দেখা যায় না বিভিন্ন হাতীয় অনুষ্ঠানে? এমন প্রশ্ন রেখেছেন কমিউনিটির নেতারা এবং সাংবাদিক নেতারা। তারা আরো প্রশ্ন তুলেছে, বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ইউরো খরচ করে শিল্পীদের নিয়ে আসার যৌক্তিকতা নিয়ে।
নিশ্চয়ই একদিন প্রথা ভেঙে ফেলবেন এই শিল্পীরা, কেননা বাংলা সংস্কৃতির চর্চাকে যারা গভীর অভিনিবেশ সহকারে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা কী পেছনে পড়ে থাকবেন? নিশ্চয়ই নয়।
বাঙালীয়ানার এই প্রদর্শনে প্রধান সমন্বয়ক আহমেদ আলী দুলাল, অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও সংগীত পরিচালনায় শিল্পী রোজী মজুমদার, যন্ত্রানুসঙ্গ নির্দেশনায় সাগর বড়ুয়া, নৃত্য পরিকল্পনা ও নির্দেশবায় জিএম শরীফুল ইসলাম, নৃত্য নির্দেশনায় দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়, সুবর্ণা তালুকদার, নাট্য নির্দেশনায় প্রদীপ কুমার বড়ূয়া টিপু, দীপক নিকোলাস গমেজ, শিশু নাট্য নির্দেশনায় রুমানা আফরোজ, আবৃত্তি নির্দেশনায় সম্পা বড়ূয়া। স্মরণিকা অনুবাদে আছেন হাসনাত জাহান, হাসান খান, শাহপরান আহমেদ অয়ন। নানা তৎপরতায় দেখা গেছে কিরনময়ী মন্ডল, এলান খান চৌধুরী, উত্তম কুমার কর্মকারসহ অনেককেই।
অনুষ্ঠানে প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক নেতা এবং অসংখ্য প্রবাসী পরিবার উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের নানা আয়োজন উপভোগ করে।