যুক্তরাজ্যে ছয় সপ্তাহের নির্বাচনি প্রচারণা শেষে শুরু হচ্ছে মূল আয়োজন। বৃহস্পতিবার ভোটের মাধ্যমে ব্রিটিশরা নির্ধারণ করবেন কার হাতে উঠতে যাচ্ছে সরকারের দায়িত্ব, কনজারভেটিভের বরিস জনসন নাকি লেবার পার্টি জেরেমি করবিন? জনসন ভোটারদের কাছে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছেন আর করবিন গুরুত্ব দিচ্ছেন জাতীয় স্বাস্থ্যসেবাকে। তবে নিশ্চিতভাবেই গুরুত্ব পাচ্ছে ব্রেক্সিট। দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে পুরো ভোট ব্যবস্থা ও ব্রেক্সিটের জন্য এই নির্বাচন কেমন তাৎপর্যপূর্ণ তা তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ভোট ব্যবস্থা
যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের বেশি যে কোনও ব্রিটিশ নাগরিক ভোট দিতে পারেন। কমনওয়েলথ ও আয়ারল্যান্ডের যোগ্য বিবেচিত নাগরিকরাও ভোট দিতে পারবেন। গত ২৬ নভেম্বর শেষ হয়েছে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ৬৫০টি আসনের ৪০ হাজার কেন্দ্রে চলবে ভোটগ্রহণ।
দেশটির নির্বাচন অন্য দেশের নির্বাচনের মতোই সাধারণ নিয়মে অনুষ্ঠিত হয়। ভোট শেশে সর্বাধিক আসনে জয়ীরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সরকার গঠন করে, এটি পেতে ব্যর্থ হলে জোট সরকার বা ঝুলন্ত পার্লামেন্ট গঠন করে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দলটি। অর্থাৎ ৪ কোটি ৬০ লাখ ভোটের ওপরই নির্ভর করছে ফল। যেই প্রার্থী তার আসন থেকে বেশি ভোট পাবেন তিনিই ওয়েস্টমিনিস্টারের হাউস অব কমন্সে মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা এমপি হয়ে বসবেন।
তবে এবারের ভোটগ্রহণের সময় ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। ডিসেম্বরে এমন নির্বাচনের ঘটনা ১৯২৩ সালের পর প্রথম। অর্থাৎ প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে পুনরায় ডিসেম্বরে দেশটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাছাড়া শীতকালে ভোটগ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল সর্বশেষ ১৯৭৪ সালে। শীতের সময় সাধারণত সেখানে ভোট হয় না। কারণ এতে দরিদ্ররা ঝামেলায় পড়েন। বিশেষ করে শ্রমিকরা। বৃহস্পতিবারের আবহাওয়া বার্তাতেও বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
ভোটেরপরযেভাবে হবে সরকার গঠন
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ১০টায় ভোটকেন্দ্র বন্ধ হবে, সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যাবে গণনার কাজ। শুক্রবারের মধ্যে ফল পাওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের অংশ হিসেবে ৬৫০ জন পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হবেন।
ভোটগ্রহণ শেষে বুথফেরত জরিপ দিতে শুরু করবে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। সেটার ফল প্রায়সময়ই সঠিক হয়ে থাকে। ভোটগ্রহণ শেষে ঘণ্টাখানকে মধ্যে রাত ১১টাতেই প্রথম বুথ ফেরত জরিপের ফল চলে আসতে পারে। আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাওয়া যাবে সবগুলোর আসনের ফল।
হাউস অব কমন্সে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য অন্তত ৩২৬টি আসন প্রয়োজন। বরিস জনসন কিংবা জেরেমি করবিন কোনও ছোট দলের সাহায্য ছাড়া যে কেউ এই সংখ্যক আসন নিশ্চিত করতে পারলে ব্রিটেনের রানির কাছে গিয়ে সরকার গঠনের কথা বলতে পারবেন।
কাদের জেতার সম্ভাবনা
নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপের ফল অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বরিস জনসনই এগিয়ে আছেন। তারই সরকার গঠনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তবে দ্য গার্ডিয়ানের পোল ট্র্যাকারে দেখা যায়, নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর সময় কনজারভেটিভরা যতটা এগিয়ে ছিল এখন সেখান থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।
সর্বশেষ জরিপ, অনুযায়ী টরিদের সম্ভাবনা ৪৩ শতাংশ, লেবার পার্টির ৩৩ শতাংশ। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ১৩, গ্রিন ও ব্রেক্সিট পার্টির ৩ শতাংশ করে। ইউগভের জরিপ অনুযায়ী, বরিস জনসন ২৮টি আসনে এগিয়ে থাকতে পারে। দুই সপ্তাহ আগেই যে সংখ্যা ছিল ২৮।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ (মার্জিনাল) আসনগুলো এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে কনজারভেটিভবিরোধী পার্টিগুলো এক হয়ে ভোটারদের ‘কৌশলী ভোট’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা ‘টরি প্রার্থীর জয় ঠেকাতে প্রথম পছন্দ নয় এমন প্রার্থীকেও ভোট দেওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছে। অর্থাৎ তারা লেবার বা টরি শিবিরের বাইরে ভোট দেওয়াকে কৌশলী ভোট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।এই ভোটের জন্য অনেক সময় জয়ী প্রার্থীর ব্যাপারে আভাস পাওয়া যায় না।
নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু
নির্বাচনি লড়াইয়ে এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ব্রেক্সিট। ২০১৬ সালের গণভোটের পর থেকেই যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিট সংকটে জর্জরিত। নির্বাচনি প্রচারণায় আরেকটি আলোচনা সামনে এসেছে, তা হলো জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা। এই খাতেও বড় দলগুলো তহবিল বাড়ানোর কথা বলছে। বিশেষ করে লেবার পার্টি সবসময়ই এই বিষয়কে সামনে আনছে। তাদের দাবি, ব্রেক্সিটের পর কনজারভেটিভরা এই খাতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেবে। এই অভিযোগ সামাল দিতে প্রচারণার শেষ দিকে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল সফর করতে হয়েছে বরিস জনসনকে।
অন্যদিকে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির দাবি, যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হওয়া। স্বাধীনতার জন্য তারা দ্বিতীয় গণভোট আয়োজনের অঙ্গীকার দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ব্রেক্সিট নিয়ে যা হচ্ছে
বরিস জনসন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আগামী বছর শেষ হওয়া আগেই ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছেন। তবে আইরিশ সীমান্ত নিয়ে এখনও স্পষ্ট করে কোনও সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানাতে পারেননি। তিনি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হন এবং ছোটদলগুলোর সহায়তা সরকার গঠন করেন তবে আগের মতোই পরিস্থিতি তৈরি হবে। চলতি বছরের প্রথম দিকে যেমন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তার প্রস্তাবিত বেক্সিট বিল আটকে গিয়েছিল. আবারও সেই পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। তবে এই সম্ভাবনা কম, কারণ তার বিরোধিতা করা টরি প্রার্থীরা পুনরায় নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না। ফলে তার সমর্থন আগের চেয়ে বেশি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে করবিনের লেবার পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়, যদিও এই সম্ভাবনা খুব কম- তবে তিনি ব্রেক্সিট নিয়ে দ্বিতীয় গণভোটের আয়োজন করবেন। আর তিনি যদি জোট সরকার গঠন করেন এবং ব্রেক্সিটবিরোধী লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি জোটসঙ্গী হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে তা এখনই অনুমান করা মুশকিল।
বাংলাট্রিবিউন