ভারতের মহারাষ্ট্রের রাজস্বমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত পাতিল জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ওই রাজ্যে ৩ মাসে ৬ শতাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছে। বিজেপি শাসিত ওই রাজ্যের বিধান সভায় বিরোধী দলীয় বিধায়কের এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন তিনি। উল্লেখ্য, ভারত সেই রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম, যেখানে কৃষকদের আত্মহত্যা প্রবণতা সবথেকে বেশি। ক’দিন আগে দাবি আদায়ের মিছিলে নেমেছিলেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা। মুম্বাইয়ের উদ্দেশে তাদের ডাকা লং মার্চে সংহতি জানিয়েছিল সারা ভারতের কৃষকসহ সচেতন জনতা।
সারাবিশ্বেই কৃষকরা বিপন্ন। তবে ভারতে এই বিপন্নতা অন্য অনেকের চেয়েই গভীর। ক্ষুদ্র কৃষকেরা সেখানে বাস করছেন দুর্যোগের কিনারায়। মহারাষ্ট্র সেই বিপন্নতার এক জীবন্ত দলিল। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র খরা, বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা, করপোরেট বাজার ব্যবস্থার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে টিকতে না পারায় সেখানে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় কৃষক। মহারাষ্ট্রে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ২৫ হাজারের বেশি কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুরক্ষার প্রশ্নে কার্যকর নীতি-পরিকল্পনার অভাব থাকার কারণেই সেখানে ক্রমাগত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন কৃষকরা। তাদের মতে, দশকের পর দশক ধরে ঋণের বোঝা থাকা, খরা ও আয় কমে যাওয়া ভারতের গ্রামাঞ্চলে কঠোর প্রভাব ফেলেছে।
রাজ্য বিধান পরিষদে বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পাতিল শনিবার জানিয়েছেন, ‘১ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে ৬৩৯ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। সরকারি বিবেচনায় ফসল নষ্ট, ঋণ এবং ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার ভিত্তিতে এদের মধ্যে ১৮৮ জনের পরিবারকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।’ পাতিল জানান ‘আত্মহত্যা করা ১৮৮ কৃষকের মধ্যে ১৭৪ জনের পরিবার এরইমধ্যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।’ তিনি জানিয়েছেন, আত্মহত্যাকারী ৩২৯ কৃষকের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে আর ১২২ জনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
বিরোধী নেতা ধনঞ্জয় মুণ্ডে রাজ্য বিজেপি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলেছেন, ঋণ মাফ, ফলন না হওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ, শস্য ঋণ বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের মতো সরকার পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থ হওয়ার কারণেই কৃষকরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিজেপি সরকারের নির্লিপ্ত আচরণ এবং মিথ্যা আশ্বাস কৃষকদের আত্মহত্যার দিকে বার বার ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধী নেতারা। মুণ্ডে অভিযোগ করেছেন, গত ৪ বছরে রাজ্যে ১৩ হাজার কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু গত এক বছরেই ১৫০০জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন।
এ বছর মার্চ মাসেই কৃষক বিক্ষোভে শুধু মহারাষ্ট্রই নয়, কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশই। কৃষকরা এক সপ্তাহ ধরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে এসে অবস্থান করেছিলেন মুম্বাইয়ে। ১০হাজার কৃষক নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে পথ হাঁটা শুরু করেছিলেন। সেই মিছিল যখন অবশেষে মুম্বাইয়ে এসে পৌঁছেছিল তার সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৪০হাজার। ১৩ দফা দাবি নিয়ে কৃষকরা জেগে উঠেছিল রক্তিম আভার মতো। তাদের পা থেকে ঝরা রক্তের ছোপ রাঙিয়ে দিয়ে গেছে নাসিক থেকে মুম্বাই-এর সুদীর্ঘ ১৮০ কিলোমিটার পথ। ‘রুশ বিপ্লব’ এবং এর পরবর্তী সময়ের নেতৃত্বকে আদর্শ মেনে মিছিলে আদিবাসী নারী-পুরুষেরা ধ্বনি তুলেছেন ‘আমিই লেনিন কিংবা আমিই স্ট্যালিন’ বলে। তবে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগের প্রেরণাকেই তারা রেখেছিলেন হৃদয়ে।
মার্চের ওই লং মার্চে অভাবনীয় অদম্য প্রতিরোধের শক্তিকে সঙ্গী করে মহারাষ্ট্রের কৃষকরা হেঁটেছেন দাবি আদায়ের মিছিলে। বুঝতে চেয়েছেন অপরের বেদনা। চাকচিক্যের মুম্বাই শহরের অগণিত মানুষ তাই পুষ্পবৃষ্টিতে সাদর অভ্যার্থনা জানায় তাদের। তৃষ্ণা আর অভূক্ত জীবনের ধারাবাহিকতা ঘোচে ছাত্রদের তুলে দেওয়া জল কিংবা বিস্কুটের প্যাকেটে। এলিট পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী সংবাদমাধ্যমগুলোও তাই বদলে যায় মুহূর্তেই। কালেভদ্রে সেখানে জায়গা পাওয়া কৃষকরা হয়ে ওঠে প্রধান খবর। কৃষকদের নিদারুণ অবস্থা বি জে পি সরকারকে সেদিন বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশ জানিয়েছিলেন,সম্পূর্ণ কৃষি ঋণ মকুব, এম এস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশগুলি রুপায়ণ, বনাঞ্চলের অধিকার প্রশ্নে কৃষকদের সব দাবিই তাঁর সরকার মেনে নেবে। তা সত্ত্বেও সেই মার্চ থেকে মে পর্যন্ত কৃষক আত্মহত্যার এমন ভয়াবহ পরিসংখ্যান উঠে এলো।