শামসুল ইসলাম ঃ১০ এপ্রিল ফ্রান্সের জনগণ পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রথম দফায় ভোট দিতে যাচ্ছেন। প্রথম দফায় কোন প্রার্থী ৫০ শতাংশের উপরে ভোট না পেলে শীর্ষ দুই প্রার্থী দ্বিতীয় দফায় লড়বেন ২৪ এপ্রিল।
এবারের নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে ইউরোপ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বের নজর আছে ফ্রান্সের আসন্ন নির্বাচনের দিকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামরিক শক্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ ফ্রান্স। এছাড়া দেশটির জাতিসংঘে রয়েছে ভেটো ক্ষমতা। ফলে আসন্ন নির্বাচনে আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফরাসীরা চাইবেন এমন নেতা বেছে নিতে যিনি পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ফ্রান্সকে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারবেন। এছাড়া মহামারী কভিড পরিস্থিতি ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় শক্তিশালী কর্ম পরিকল্পনা প্রনয়ণ, বেকারত্ব এসব বিষয় বিবেচনায় নিবেন ভোটাররা।
এবারের নির্বাচনে রেকর্ড পরিমান প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল লড়াইয়ে এগিয়ে আছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো, কট্টরপন্থী মারিন ল্য পেন, ডানপন্থী ল্য রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ভালেরি প্যাক্রেস, কট্টর বামপন্থী ফ্রান্স ইন্সনেম প্রার্থী জন লুক ম্যালনশোঁ, একসময়ের শক্তিশালী দল ‘সমাজবাদী দলে’র প্রার্থী প্যারিসের মেয়র আন ইদালগো। এছাড়া আরেক কট্টরপন্থী অভিবাসন বিরুধী হিসাবে পরিচিত, টিভি ব্যাক্তিত্ব এরিক জুমো আছেন আলোচনায়। তিনি সরাসরি ইসলাম বিরুধী হিসাবে নিজেকে পরিচয় দেন। তিনি ফ্রান্সে মুসলমানদের চান না। সম্প্রতি ম্যাক্রোঁকে হত্যাকারী বলে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন।
প্রথম দফার নির্বাচনে কেউই ৫০ শতাংশের উপরে ভোট পাবেন না বলে বিভিন্ন জরীপে স্পষ্ট উঠে এসেছে। ফলে নিশ্চিত ভাবেই দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রায় সকল জরীপেই এগিয়ে আছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো। সেদিক থেকে প্রথম দফায় তার শীর্ষ দুইয়ের থাকা অনেকটা নিশ্চিত। তার সাথে দ্বিতীয় বা চুড়ান্ত লড়াইয়ে কে থাকবেন এটাই সবার আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। এক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন গতবারের ফাইনালিস্ট কট্টরপন্থী নেত্রী ম্যারিন ল্য পেন। তিনি ক্রমেই প্রথম রাউন্ডে ম্যাক্রোঁর সাথে ব্যবধান কমিয়ে আনছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা ম্যারিন ল্য পেনকে বেকায়দায় ফেললেও সাম্প্রতিক সপ্তাহে তিনি এগিয়েছেন। যদিও দ্বিতীয় রাউন্ডে তার জয়ের সম্ভাবনা কম। ল্য পেন অতীতে নিজেকে ইউরোপ বিরুধী বলে প্রচার করেছেন। এমনকি তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ফ্রান্সকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরো থেকে বের করে আনার কথা বলেছেন। অবশ্য ২০১৯ সালে তিনি তার এ অবস্থান ত্যাগ করেন। তবে তিনি ইসলামোফোবিয়ায় ভোগেন বলে সমালোচনা আছে। তিনি অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে তার তার কট্টরপন্থী ভাবমূর্তিকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করছেন। ইমিগ্রেশন, ইসলাম বিদ্বেষের তুলনায় অর্থনৈতিক ইস্যুতে যেমন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো, উচ্চ জ্বালানী মূল্য পরিশোধে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ কর্মজীবীদের পক্ষে কথা বলছেন। তবে তার উত্তরসূরী হিসাবে পরিচিত তার ভাতিজি মারিন মার্শেল তার এমন অবস্থান পরিবর্তনে তার সংঘ ত্যাগ করে কট্টরপন্থী এরিক জুমোকে সমর্থন করেছেন।
এদিকে গত নির্বাচনের আরেক আলোচিত প্রার্থী কট্টর বামপন্থী লা ফ্রান্স ইন্সোমিসের জন লোক মেলন্সো। প্রথম রাউন্ডে দ্বিতীয় সেরা হওয়ার দৌড়ে তিনিও আশা বাচিয়ে রেখেছেন। বিএফএম টিভির এক সর্বসাম্প্রতিক জরীপে আরেক কট্টরপন্থী এরিক জমুকে পেছনে ফেলে ল্য পেনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন মিষ্টার মেলনশো। মেলনশো রাশিয়ায় ফরাসি অস্ত্র সর্বরাহের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বিজয়ী হলে ফ্রান্সকে ন্যাটো থেকে বের করে আনবেন বলে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছেন। তিনি অর্থনীতিতে সরিকারের হাতে রাখতে চান এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি তার। এছাড়া তিনি অবসরের বয়স সীমা আরো কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে দ্বিতীয় দফায় ম্যাক্রোঁর সাথে তারও জয়লাভের সম্ভাবনা কম।
ফ্রান্সের ঐতিহ্যগত ডানপন্থী দল হিসাবে পরিচিত, (যে দলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জ্যাক শিরাক ও নিকোলাস সার্কজি) ল্য রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ভালেরি পেসকাস (যিনি ইল দ্য ফ্রান্স রিজিওনের প্রেসিডেন্ট) রয়েছেন পঞ্চম অবস্থানে। সম্প্রতি কভিড আক্রান্ত হয়ে বিশ্রামে থাকা এ নেত্রী তার অবস্থানকে শক্ত করতে পুরনো ইমগ্রেশন ইস্যুতে জোর দিয়েছেন। নির্বাচিত হলে ফ্রেঞ্চ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে অবৈধ ইমিগ্রেশনের রাশ টেনে ধরবেন তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি দাবি করছেন তিনি হবেন ফ্রান্সের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। তবে নিজেকে এক তৃতীয়াংশ মার্গারেট থেচার ও দুই তৃতীয়াংশ এঞ্জেলা মার্কেল বলে বর্ননা করার পর তার জনপ্রিয়তা নিম্নগামী হয়েছে। বিভিন্ন জরীপে তার ভোট ১০ শতাংশের নিজে দেখানো হচ্ছে।
এছাড়া ফ্রান্সের আরেক ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক দল সমাজবাদী দলের প্রার্থী, প্যারিসের মেয়র আন ইদালগোর অবস্থান একেবারেই তলানিতে। ম্যাক্রোর পূর্বে ফ্রন্সোয়া ওঁলান্দ এদল থেকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর আগে ফ্রঁন্সোয়া মিতরা দুই দফায় ১৪ বছর এই দলের হয়ে ক্ষমতায় ছিলেন। এসময় তিনি আজকের ফ্রান্সের অনেক রিফর্মের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো এখনো পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। ম্যাক্রো তার পাঁচ বছরের শাসনে বিভিন্ন বিতর্ক তৈরি করলেও বিগত নির্বাচনে তার দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। তার শাসনামলে তিনি সবচেয়ে নাজুক সময় পার করেন আলোচিত ইয়েলো ভেস্ট বা জিলে জুন আন্দোলনের সময়। তখন টানা কয়েকমাস ধরে আন্দোলনকারীরা রাজধানী প্যারিসহ অনেক শহুর অনেকটা অবরুদ্ধ করে রাখেন। তবে কৌশলী ম্যাক্রোঁ ধীরে ধীরে এ আন্দোলন দমিয়ে আনতে সক্ষম হন।
কভিড ১৯ মোকাবিলায় ম্যাক্রোঁ সরকার অনেকটাই সফল হয়ছে। প্রথম দিকে ভেকসিন কর্মসূচি মন্থর হলেও দ্রুত এ অবস্থা কাটিয়ে উঠে। কভিড পরবর্তী ফ্রান্সের অর্থনীতিতে গতি ফিরাতে তিনি অ একটা সফল হয়েছেন যা তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ভূমিকা রাখছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ ম্যাক্রোঁকে বিশ্ব দরবারে সামনের কাতারে নিয়ে আসে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে সবসময় পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি ফ্রান্সকে কৌশলে এযুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। একজন্য অবশ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জুলানাস্কির সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
এবারের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের তুলনায় ম্যাক্রোঁ বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছেন।
গতবারের তুলনায় হেভিওয়েট প্রার্থীও কম এবারের নির্বাচনে। প্রথম দফায় এখন পর্যন্ত তার সাথে অন্য প্রার্থীদের ফারাক অনেক বেশি। দ্বিতীয় রাউন্ডে ম্যারিন ল্য পেন আসলে কৌশলগত ভাবে এগিয়ে থাকবেন ম্যাক্রো। কারণ দুই প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনে তখন বাম, ডান, মধ্য ডানের অধিকাংশ ভোটই যাবে তার বাক্সে। ম্যারিন ল্য প্যান ঠেকাও ইস্যুতে তিনি থাকবেন সুবিধাজনক অবস্থানে। এভাবে ম্যাক্রো দ্বিতীয় বার নির্বাচিত হলে জ্যাক শিরাকের পর তিনি হবেন দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট যিনি পরপর দুই মেয়েদে এলিজে প্রাসাদের বাসিন্দা হবেন। তার আগে জেনারেল দ্য গল, ফ্রান্সোয়া মিতরা এবং জ্যাক শিরাক দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন। প্রসংগত, ফ্রান্সের সংবিধান অনুযায়ী এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের অধিক প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না।