টরন্টোতে এবারই প্রথম ড্রাইভ থ্রু হ্যালোইন হয়েছে, সিপি ২৪ চ্যানেলে খবরে দেখলাম। হেমন্তের এই সুন্দর পড়ন্ত বিকেলে প্রকৃতিতে শুধু রঙের খেলা, বাহারি পাতা আর হ্যালোইনের সাজে সেজে আছে গোটা শহর। কিন্তু কী যেন এক বিষণ্নতায় ঘিরে আছে সবার মন—টরন্টো, কানাডা, বাংলাদেশ, আমেরিকাসহ পৃথিবীজুড়ে এই বিষণ্নতা। কোভিড-১৯ এই বছরের মার্চ মাস থেকেই সবার মধ্যে নিয়ে এসেছে এক মহা আতঙ্ক। যে আতঙ্কের এখনো কোনো শেষ নেই, দ্বিতীয় ঢেউ চলছে সবখানে। অথচ কত নতুন আশা আর স্বপ্ন নিয়েই না শুরু হয়েছিল ২০২০!
গত বছরের মার্চের ১২ তারিখে যখন কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী ২০২০-২২ এই তিন বছরে ১০ লাখ অভিবাসী আনার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সবার মতো আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম। এর পরপরই কোভিড-১৯ শুরু হয়, সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পিআর হিসেবে ল্যান্ডিং ২০২০–এর আগস্টে ২০১৯–এর তুলনায় ৬৪ শতাংশ কমে যায়। ইমিগ্রেশন কানাডা ২০২০ সালে ঠিক কতজন পিআর হিসেবে ল্যান্ড করতে পেরেছে, সে তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেনি। তবে তারা বলছে, টার্গেটের ৩ লাখ ৪১ হাজারের অর্ধেককে হলেও তারা কাজ করে যাচ্ছে পিআর হিসেবে আনার। হেলথ অ্যান্ড সেফটি ফার্স্ট, আর তাই ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন ও ম্যান্ডেটরি কোয়ারেন্টিন থাকাতে, সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টা আগের কোভিড নেগেটিভ টেস্টিং রিপোর্ট বাধ্যতামূলক হওয়ায় ইমিগ্রান্টদের ল্যান্ডিং অবশ্যই অনেক অনেক কমে গেছে। আমাদের সবার দৈনন্দিন জীবন থেকে কত পার্বণ, কত পরিকল্পনা, কত স্বপ্ন, কত উৎসব উঠে গেছে। আমাদের কত কাছের মানুষ মারা গেছেন, অসুস্থ হয়েছেন এই মহামারিতে।
মোটামুটিভাবে কারও কোনো পরিকল্পনাও আর ঠিক থাকেনি। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক, ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস। স্রষ্টার ইচ্ছার ওপরে কারও কোনো হাত নেই।
২০২১–২৩ সালের মধ্যে ১২ লাখ ৩৩ হাজার অভিবাসী
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা। বিশাল আয়তনের দেশটিতে একমাত্র আদিবাসী অল্প কিছু মানুষ ছাড়া সবাই অভিবাসী। আদিবাসীদের পূর্বপুরুষেরাও রেড ইন্ডিয়ান নামে খ্যাত। অর্থাৎ তাঁদের পূর্বপুরুষেরাও এসেছিলেন অন্য দেশ থেকে। সে যা–ই হোক, আমরা সবাই সেটলার, আদিবাসীদের জায়গা দখল করে নিয়েছি, আমরা তাঁদের কাছে ঋণী। তাঁদের প্রতি আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে, সে অনুযায়ী আমাদের কাজ ও পরিকল্পনা করা উচিত। ইমিগ্রান্টরাই তাই এই দেশের চালিকা শক্তি। এ দেশে জন্মহার বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হওয়া যাচ্ছে না, বয়স্ক লোকজনের সংখ্যাই এখানে বেশি। কোভিড-১৯–এর সময় কানাডা যেভাবে মানবিকতা, বিজ্ঞান আর বিচক্ষণতার মাধ্যমে কানাডিয়ানদের সুরক্ষার চেষ্টা করছে, যেভাবে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট, ভিজিটর, ওয়ার্কার, রিফিউজিদের সঙ্গে আচরণ করেছে, কূটনৈতিকভাবে প্রতিবেশী দেশ আমেরিকা, বিতর্কিত চীন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে যেভাবে সহ–অবস্থান করেছে, তা কানাডার অবস্থানকে বিশ্বে আরও মহিমান্বিত করেছে। আর তাই কানাডায় অভিবাসনের ইচ্ছা সারা বিশ্বে আরও বেড়ে গেছে। এই ইচ্ছায় আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে গত বছরের ৩০ অক্টোবর কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী মার্কো মেন্ডিচিনুর ২০২১–২৩ সালের মধ্যে ১২ লক্ষ ৩৩ হাজার অভিবাসী আনার ঘোষণা। এই পরিকল্পনায় বড় বড় সিটির বাইরে সুনির্দিষ্ট কম জনবহুল এলাকায় সেখানকার সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য ইমিগ্রান্টদের আনা হবে। আগামী তিন বছরে ৬০ শতাংশ নেওয়া হবে দক্ষ অভিবাসী—এক্সপ্রেস এন্ট্রি, পিএনপি, অ্যাগ্রিফুড পাইলট প্রোগ্রাম, রুরাল অ্যান্ড নর্থার্ন ও মিউনিসিপাল পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে। ফ্যামিলি ক্লাস, রিফিউজি স্পনসরশিপ, হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যান্ড কম্পাশনেট ও অ্যাসাইলাম ক্যাটাগরিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
মন্ত্রীর লক্ষ্যটা মোটামুটি এ রকম—
২০২১ সালে—৪,০১,০০০ জন অভিবাসী,
২০২২ সালে—৪,১১,০০০ জন অভিবাসী,
২০২৩ সালে—৪,২১,০০০ জন অভিবাসী আনার পরিকল্পনা আছে কানাডায়।
কানাডার ইতিহাসে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা এটি। একমাত্র ১৯১৩ সালে কানাডাতে ৪ লাখ ১ হাজার ইমিগ্রেন্ট আনা হয়। কানাডিয়ানদের স্বাস্থ্যসেবাসহ ইনফরমেশন টেকনোলজি, ফুড সেক্টর, অ্যাগ্রোফুড, ফার্মিংসহ অন্য সব ক্ষেত্রেই কোভিডের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে কানাডার অর্থনীতিকে চাঙা করতে, নতুন চাকরি সৃষ্টির জন্য বেশি বেশি সংখ্যায় অভিবাসী আনা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই।
মন্ত্রী মেন্ডিচিনুর এই ঘোষণায় কানাডার ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলেছেন, কানাডা নিজেই যেখানে কোভিডের কারণে বিশাল অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, তখন কী দরকার বাইরে থেকে লোক আনার? কোভিড-১৯ কানাডার পলিসিমেকারদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কানাডায় জনবল কত দরকার, আর তাই কানাডা তার নিজের প্রয়োজনেই অভিবাসী আনবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুধু পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়ন তো করতে হবে। আর তা করতে গেলে যুগোপযোগী আধুনিক ব্যবস্থা নিতে হবে, অভিবাসনের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে, সর্বোপরি অভিবাসন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানোর জন্য জনবল বাড়াতে হবে।
অভিবাসনের দীর্ঘসূত্রতা কি কমবে
কানাডিয়ান অভিবাসনের দীর্ঘসূত্রতা কোভিড-১৯–এর আগে থেকেই ছিল। আর এ নিয়ে হতাশার কোনো শেষ নেই। হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যান্ড কম্পাশনাট গ্রাউন্ড অ্যাপ্লিকেশন প্রসেসিং টাইম ৩৬ মাস, ৫ হাজার স্পাউসল স্পনসরশিপ অ্যাপ্লিকেশনস ঝুলে আছে ৩ বছরের বেশি সময় ধরে। আর তাই ১৯ সেপ্টেম্বরে কানাডার এডমন্টন, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া, টরন্টো, ভ্যানকুভারসহ বিভিন্ন শহরে ভালোবাসার প্রতীক লাল পোশাকে সজ্জিত হয়ে হাজারো বিক্ষোভকারী প্রতিবাদ জানায়। এনডিপি লিডার জেনি কাউয়ান অভিভাসন মিনিস্টারকে বিশেষ চিঠি দিয়ে দাবি করেন হাজারো স্পাউসল স্পনসরশিপ আবেদনকারীদের বিশেষ টেম্পোরারি রেসিডেন্ট ভিসা দেওয়ার জন্য। ইমিগ্রেশনের সরকারি ওয়েবসাইট আনুমানিক প্রসেসিং টাইম দেওয়া থাকে। সেখানে নোটিশ দেওয়া আছে মহামারির জন্য সঠিক প্রসেসিং টাইম দেওয়া সম্ভব নয়। কোভিডের আগেই কানাডিয়ান নাগরিকত্বের আবেদন প্রসেসিংয়ে এক বছর সময় লাগত, মহামারির সময় প্রথম ভার্চ্যুয়াল সিটিজেনশিপ অথোটেকিং হয়।
অভিবাসন সাক্ষাৎকারে ভার্চ্যুয়াল হওয়া উচিত অন্যথায় কানাডিয়ান অভিবাসনে টার্গেট ও প্রসেসিং ডিলেই শুধু বাড়বে। আশা করি, ইমিগ্রেশন রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা অতি দ্রুত জনবল বাড়িয়ে, ডিজিটালাইজড মডার্ন সিস্টেম ইমপ্রুভ করে ইমিগ্রেশন টার্গেট ফুলফিল করবে অতি দ্রুত। আসুন পজিটিভ চিন্তা করি, সবাই ভালো থাকি আর ভালো রাখি সবাইকে। ছোট্ট এই জীবনের চাওয়া–পাওয়া খুব বেশি নয়।
*লেখক: মাহমুদা নাসরিন, শিক্ষক ও সমাজকর্মী, টরন্টো, কানাডা। সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
প্রথম আলো সূত্রে