‘এই তো বাংলাদেশ’ – উপস্থিত অসংখ্য মানুষের কোলাহল-মুখরতা ভেদ করে ‘কানের ভেতর দিয়া মরমে পশিলো’ – যেন এমনই অনুভূতি হলো। ঘার ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি বাংলাদেশের স্টলের সামনে উৎসুক জনাকয়েক ভিনদেশী। গভীর দৃষ্টি দিয়ে বাংলাদেশ ষ্টলের টেবিলে সাজানো রকমারী পিঠা আর মিষ্টিজাত খাবার! প্রতিটি খাবারের পরিচিতি, ইনগ্রিডিয়েন্টস এবং প্রস্তুত প্রণালী পড়ে দেখছে। পাশে দাড়িয়ে সাজানো খাবারগুলোর ব্যাপারে আরো কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য ফরাসী এবং ইংরেজী দুই ভাষাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন মেজর রিয়াজ মাহমুদ এবং দূতাবাসের অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা। এরপর রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে চেখে দেখা! রসনার তৃপ্তির মাত্রাটির নিরুপক হয়ে ওঠে মুখাবয়বগুলো। এরপর অভিব্যক্তিতে স্বাদের চূড়ান্ত রায়! এমনিভাবেই তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বাংলাদেশী খাবারের প্রশংসা করেছেন উপস্থিত নানা দেশের নানা মানুষেরা।
মঙ্গলবার (১৬ মে) প্যারিসের একোল মিলিট্যাহ (École Militaire) এলাকাটি পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর বর্নিল সুভেনির হয়ে উঠেছে। বহুজাতিক পৃথিবীর এটিই একটি বর্নাঢ্য রূপ, যাপিত জীবন, খাবার-দাবার, পোষাক আষাকে ভিন্নতা। কিন্তু সহাবস্থান, শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভাষা এক, অভিন্ন। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ সর্বাবস্থায় শান্তির সংগী। আন্তর্জাতিক ও ভূরাজনৈতিক নানা ঘাত-অভিঘাতে এবং মেরুকরণের ঘেরাটোপেও স্পষ্টতই শান্তির পক্ষে বাংলাদেশ।
‘আন্তর্জাতিক সন্ধ্যা’ আয়োজনে বাংলাদেশকে আলাদা করে, ভিন্নতর আঙ্গিকে তুলে ধরার এই আয়োজন করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এই উদ্যোগের ‘ক্যাটালিস্ট’ হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ থেকে সামরিক বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে আসা মেজর রিয়াজ মাহমুদ। তার ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হবার আগে ‘আন্তর্জাতিক রাত’ নামের ইভেন্ট এর আয়োজ করা হয়। তবে এই পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন করতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখেন দূতাবাসের সামরিক এটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান। এমন আয়োজনে বাংলাদেশের উপস্থিতি নিশ্চিতে তার আগ্রহ এবং সার্বিক তত্ত্বাবধান প্রধান ভূমিকা রাখে।
এই আয়োজন অনুষ্ঠান হয় প্রতিবছরই। পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে নানা দেশের সামরবিজ্ঞানের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার জন্য École de Guerre এ আসে। এই প্রশিক্ষণার্থীদের সমাপনী আয়োজনই মূলতঃ এটি। এবছর প্রায় অর্ধশত দেশের চৌকস ও মেধাবী সমর-শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেধাবী অফিসার মেজর রিয়াজ মাহমুদ এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। গত ১৮ বছর পর একজন বাংলাদেশী অফিসার এই সুযোগ পেলো।
মূলতঃ মেজর রিয়াজ মাহমুদের উৎসাহ এবং ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের মান্যবর রাষ্ট্রদূত এবং সামরিক এটাশে এর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় বহুজাতিক এই আয়োজনে বাংলাদেশের পতাকা এবং ঐতিহ্যমন্ডিত খাবারকে তুলে ধরবার প্রয়াস নেয়া হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত এম তালহা এবং সামরিক এটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান সহ তাদের কয়েকটি পরিবার উপস্থিত হন।
প্যাভিলিয়ন জফরে (Pavillon Joffre) এর ভেতরে বাইরে প্রায় ৪৬ টি দেশ তাদের নিজস্ব নানা স্বাদের খাবার, পানীয়, ফলমূল এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পোষাক, হস্তশিল্প নিয়ে নিজেদের স্টল সাজিয়ে স্ব স্ব দেশের নিজস্বতা তুলে ধরেন। সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত এলাকায় এমন একটি আয়োজন এবং বিশেষ ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ সত্বেও বিপুল সংখ্যক দর্শক উপস্থিত হয়।
এই আয়োজনে বিভিন্ন দেশ, জাতিগোষ্ঠী কেবল তাদের খাবার নিয়েই উপস্থিত ছিলো না, বিভিন্ন দেশের নাচ আর গান আর বাদ্যযন্ত্রের কাঁপুনি ধরা শব্দে সেনানিবাসের গাম্ভীর্যে যেন ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে।
কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত এই এলাকাটি সশস্ত্র বাহিনী, অধিদপ্তর এবং পরিষেবাগুলির ২০০ জন ফরাসি অফিসার, ৬৬ টি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং মিত্র দেশগুলির ৮৮ জন আন্তর্জাতিক অফিসার এবং সেইসাথে সুশীল সমাজের ৪৪ জন মুক্ত নিরীক্ষকের সমন্বয়ে পরিচালিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।
এব্যাপারে কথা হয় মেজর রিয়াজ মাহমুদের সাথে। মাদারীপুরের সনৃতান রিয়াজ মাহমুদ জানান, বাছাইয়ের নানা কঠিন ধাপ পেরিয়ে এই প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করা সম্ভব হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলে শান্তি রক্ষী বাহিনীতে কাজ করতে পারার সুবাদে ফরাসী ভাষা টুকটাক শেখা হয়েছিলো। কিন্তু ফ্রান্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য রিয়াজ মাহমুদ বাংলাদেশ থেকেই বি -২ লেভেল শেষ করে আসতে হয়েছিলো। এব্যাপারে তিনি ঢাকাস্থ আলিয়ঁস ফ্রসেজ এ ফরাসী ভাষার ওপর ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন।
১৮ বছর পর প্রশিক্ষণে সুযোগ পাওয়া মেজর রিয়াজ মাহমুদ নিজের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদাকে তুলে ধরেছেন। এই আয়োজনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন দেয়ার চেষ্টার ফলেও বাংলাদেশকে হয়তো কোনো অচেনা বিশ্ব নাগরিকের কাছে নতুন পরিচয়ে বিধৃত করেছে।
এই আয়োজনে দূতাবাস যেমন তার সঠিক কর্তব্যবোধের পরিচয় দিয়েছে, তেমনি রিয়াজ মাহমুদ এর প্রশিক্ষণের এই সুযোগকে নবীণ সৈনিকদের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে বলে আশাবাদ সৃষ্টি করেছে।