স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকে আইনি ভিত্তি প্রদান এবংপিলখানা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারিগর দিল্লির শাসকদের বিরুদ্ধেআইনানুগ ও কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে অখণ্ড বাংলাদেশআন্দোলন একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
৩০ নভেম্বর, রবিবার: ২০০৯ সালের ২৫–২৬ ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীরপিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে এরআইনি ভিত্তি প্রদানসহ সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করারপাশাপাশি জড়িত সংগঠন ও দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগব্যবস্থা গ্রহণ এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারিগর দিল্লিরশাসকদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে অখণ্ডবাংলাদেশ আন্দোলন।
রবিবার সন্ধ্যায় ‘অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এর আহ্বায়কহাসনাত আরিয়ান খান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই দাবি জানায়সংগঠনটি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থার কথা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনেরপ্রকাশিত প্রতিবেদনকে আমরা স্বাগত জানাই। একইসাথে এইপ্রতিবেদনের আইনি ভিত্তি প্রদানের দাবি জানাই। পিলখানাহত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ বের করে জাতির সামনে তুলে ধরার জন্যকমিশনের সদস্যবৃন্দেরকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। আমরা যেটাঅনুমান করেছিলাম আজ সেটাই স্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদনে সত্যবলে প্রমাণিত হয়েছে। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জনসেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণহানি শুধুই একটি পরিকল্পিতহত্যাকান্ড নয়, এটি জাতিগত বিপর্যয়। এই ঘটনার সত্য জানারঅধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। কমিশনের প্রধান মেজরজেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেছেন, প্রতিবেদনটিক্ল্যাসিফায়েড বা গোপনীয় নয়। সরকার চাইলে এটি প্রকাশ করতেপারে। আমরা অবিলম্বে সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে এবংওয়েবসাইটে প্রকাশ করার পাশাপাশি প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোবাস্তবায়নের জোর দাবি জানাই।”
অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন জানায়, “কমিশনের প্রতিবেদনে বলাহয়েছে—‘২০০৯ সালের এই হত্যাযজ্ঞ ছিল পরিকল্পিত, এতেতৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে জড়িত ছিল এবংমূল সমন্বয়কারী ছিলেন সাবেক সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপস।পুরো ঘটনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রিনসিগন্যাল ছিলো এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা পিলখানায়প্রবেশ করে খুনিদের রক্ষা করেছেন।’ শেখ হাসিনা ইন্ডিয়ার স্বার্থেআর নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকরেছেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এবং বহুআলামত নষ্ট হওয়ার বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পিলখানাহত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বিচার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাধীনট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে। কমিশনেরপ্রতিবেদন অনুযায়ী আলামত নষ্ট করাসহ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডেরসঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, যাদের নাম প্রতিবেদনে এসেছেতাদের দ্রুত গ্রেফতার করে সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কঠোরশাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা জড়িত সংগঠন ও দোষী ব্যক্তিদেরবিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।”
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, “পিলখানায় সংঘটিত নৃশংসহত্যাকাণ্ডে ইন্ডিয়ান কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততার তথ্য প্রমাণ পাওয়ার কথাউল্লেখ করে তদন্ত কমিশনের প্রধান বলেছেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরেপিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। ওই ঘটনার সময় ৯২১জন ভারতীয় বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার মধ্যে ৬৭ জনের কোনওহিসাব নেই। তাঁরা কোন দিক দিয়ে এসেছিলেন, কোথা দিয়ে বেরিয়েগিয়েছেন, জানা যাচ্ছে না। আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশেরস্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চেয়েছিল ভারত। সেনাবাহিনী ও বিজিবি–কেদুর্বল করতে চেয়েছিল। বিডিআর কার্নেজটা হওয়ার পর সরকার তারক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেঅস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল।’ স্বাধীন দেশের ভূখণ্ডে বিদেশিনাগরিকদের এমন গোপন উপস্থিতি এবং তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ারাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর এক উচ্চমাত্রার হুমকি।প্রতিবেদনে পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দিল্লির শাসকদেরসম্পৃক্ততা, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা এবংসেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করার উদ্দেশ্য প্রকাশ পাওয়ার পরদেশের মুক্তিকামী জনগণ দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গভীরউদ্বেগে নিমজ্জিত হয়েছে। ৬৭ জনের খোঁজ নিতে অন্তর্বর্তীকালীনসরকারকে ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছে তদন্ত কমিশন।আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে ওই ৬৭ জনের বিষয়েদ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহপরিকল্পিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেই সময়ের ইন্ডিয়ারপ্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রশাসনের ভূমিকার জবাব চাওয়ারপাশাপাশি ইন্ডিয়া থেকে আসা ব্যক্তিবর্গ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারিগরদিল্লির শাসকদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণেরজোর দাবি জানাই।”
অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন আরও জানায়, “দীর্ঘ ১৬ বছর শহিদসেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো অবহেলা, ভান করা সহমর্মিতা আরমিথ্যা আশ্বাসই পেয়েছে। এবার পরিবারগুলোর আস্থা ফিরিয়ে আনারসুযোগ এসেছে। পিলখানায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত সামরিক ও বেসামরিকব্যক্তিদের কেউ যেন বিচার থেকে রেহাই না পায়, সে বিষয়ে সরকারকেকঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মীর জাফরদের বিচার করা না গেলেএ দেশে ভবিষ্যতে আরেকটা পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আশঙ্কারয়েছে। কাজেই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে। একইসাথে স্বাধীনতদন্ত কমিশনের সকল তদন্ত কর্মকর্তা ও স্বাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে হবে। শহিদ পরিবারসহ এই ঘটনার ভুক্তভোগীদের উপযুক্তক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমরা এই ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ও স্বাক্ষীদেরনিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানাই। আমরা শহিদ পরিবারসহ সকলভুক্তভোগীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানাই।
উল্লেখ্য, পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজরজেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যাকরে লাশ গুম করা হয়। হত্যা করা হয় মেজর জেনারেল শাকিলআহমেদের স্ত্রী নাজনীন হোসেন শাকিলকেও। দেশের গণ্ডি পেরিয়েআন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের এঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লোক দেখানো তদন্ত ওবিচারের নামে প্রহসন চলে। দেড় দশক পর আওয়ামী লীগ সরকারেরপতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এলে ওই ঘটনার পুনঃতদন্ত ওন্যায় বিচারের দাবি ওঠে। ১৯ ডিসেম্বর পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায়সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উআহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে(আইসিটিতে) অভিযোগ করেন শহিদ সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারেরসদস্যরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় স্বাধীন তদন্তকমিশন গঠন করে দেয় সরকার। প্রথমে তিন মাস সময় দেওয়া হলেওপরে সময় বাড়ানো হয়। প্রতিবেদন তৈরি করতে ২৪৭ জনের সাক্ষ্যনেওয়া হয়। এদের মধ্যে নিহত পরিবারের ১৪ সদস্য, রাজনৈতিকব্যক্তি ১০ জন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা, সামরিক কর্মকর্তা১৩০ জন, বেসামরিক কর্মকর্তা চারজন, পুলিশ কর্মকর্তা ২২ জন, বেসামরিক ব্যক্তি নয়জন, সাবেক ও বর্তমান বিডিআর বা বিজিবিসদস্য ২২ জন, কারাগারে থাকা ২৬ জন ও তিনজন সাংবাদিকেরস্বাক্ষ্য বা জবানবন্দি নিয়েছে কমিশন। স্বাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বর্তমানসেনাপ্রধানেরও। ১১ মাস ধরে তদন্ত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করে এইকমিশন। রবিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টাঅধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরসন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএমের নতুন ভবনে সংবাদসম্মেলন করে তদন্ত কমিশন। কমিশন প্রধান সংবাদ সম্মেলনে তদন্তপ্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। স্বাধীন তদন্ত কমিশন–সংশ্লিষ্টএকটি সূত্র জানিয়েছে, উল্লেখিত নামের বাইরেও অনেক নাম তদন্তপ্রতিবেদনে রয়েছে। সংগত কারণে সেসব নাম এখনই সামনে আসছেনা। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনটিপাবলিক (উন্মুক্ত) করলে সবার বিষয়ে দেশের মানুষ জানতে পারবে।










