দর্পণ প্রতিবেদন : ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে এই সপ্তাহে কী ঘটছে তা বোঝা একটা কঠিন বিষয়— দেশটি লড়ছে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাজেট নিয়ে।
প্রথম জটিলতা হলো— এটি একটি নয়, দুটি বাজেট।
মূল রাষ্ট্রীয় বাজেটের জোগান কিভাবে হবে তা জাতীয় সংসদে ধীরগতিতে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আবার তিন কর্মদিবসে প্রায় ২,৭০০টি সংশোধনীতে ভোট দিতে হবে, অথচ দিনে ১শটিরও কম সম্পন্ন হচ্ছে।
একই সঙ্গে সংসদের অর্থায়ন কমিটিতে সামাজিক নিরাপত্তা (Social Security বা “Sécu”) বাজেট নিয়েও আলোচনা চলছে। ডানপন্থী ও বামপন্থী দলগুলো একজোট হয়ে সরকারের প্রস্তাবিত ২৩ বিলিয়ন ইউরোর ঘাটতি পূরণের বেশিরভাগ পদক্ষেপ বাতিল করে দিচ্ছে।
তারা আগামী বছরের পেনশন স্থগিত রাখার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচে নাগরিকদের অবদানের সামান্য বৃদ্ধির প্রস্তাবও নাকচ করেছে।
কমিটি সম্ভবত পুরো স্যেকু বাজেটই বাতিল করবে— যেমনটি তারা গত সপ্তাহে মূল বাজেটের ক্ষেত্রেও করেছিল। যদিও এই প্রত্যাখ্যান কেবল “প্রতীকী”, ফলে অপরিবর্তিত খসড়াই মূল সংসদে যাবে।
ফ্রান্স এক রাজনৈতিক পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে
দেশটির বাজেট ঘাটতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সর্বোচ্চ (এই বছর জিডিপির ৫.৪%)। ঋণ রেটিং সংস্থা ও বন্ড বাজারের চাপের মুখে, ফরাসি পার্লামেন্টকে ৭০ বছর পর প্রথমবারের মতো বাজেট গঠনের প্রকৃত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
১৯৫০-এর দশক থেকে প্রতিটি ফরাসি বাজেট সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অথবা সংবিধানের ধারা ৪৯.৩ ব্যবহার করে পাশ করানো হয়েছে।
কিন্তু এবার কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। প্রধানমন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকর্নু সর্বোচ্চ ৫৭৭ আসনের মধ্যে মাত্র ১৭০টি আসনে নিয়ন্ত্রণ রাখেন। সাম্প্রতিক দুই অনাস্থা ভোটে সমাজতন্ত্রীদের নিরপেক্ষ অবস্থানের বিনিময়ে তিনি ৪৯.৩ ধারা ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করেন।
ফলে এখন একটি বিভক্ত সংসদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সবচেয়ে কঠিন বাজেট নিয়ে।
ডানপন্থী ও মধ্যপন্থী জোটের একটি অংশ প্রায় সব কর বৃদ্ধির বিরোধী। বামপন্থীরা ব্যয় কমানোর বিপক্ষে। সমাজতন্ত্রীরা ধনীদের ও বড় ব্যবসার ওপর নতুন কর চায়; রিপাবলিকানরা কোনো কর বাড়াতে রাজি নয়।
অন্যদিকে, কট্টর ডানপন্থীরা সব কর বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাসের বিরোধী— তবে বিদেশি কোম্পানি ও অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চায়। এক পর্যায়ে মেরিন ল্য পেনের দল এমনকি সরকারের কর আরোপের সাংবিধানিক অধিকারটির বিরুদ্ধেও ভোট দেয়— যা পরে ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
২৩ নভেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদকে সংশোধিত বাজেট পাস করতে হবে। এরপর সেটি যাবে উচ্চকক্ষে (সেনেট), যা কর বৃদ্ধি-বিরোধী মনোভাবের জন্য পরিচিত। ফলে সেনেট অনেক সংশোধনী বাতিল করে নিজের প্রস্তাব যোগ করবে।
এরপর দুই কক্ষের যৌথ কমিটি সমঝোতা প্রস্তাব তৈরি করবে, যা ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদে অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বাজেট নাকচ হলে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ আর্থিক আইন প্রণয়ন করতে হবে।
যদি সংসদ ৭০ দিনের মধ্যে (অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বরের আগে) কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, সরকার সংবিধানের ধারা ৪৭ অনুযায়ী নিজের বাজেট ডিক্রির মাধ্যমে প্রয়োগ করতে পারবে— যা আগে কখনো ঘটেনি।
বিশেষ ডিক্রির মাধ্যমে বাজেট পাশ হতে পারে
এই জটিল পরিস্থিতিতে আবার প্রশ্ন উঠছে— সরকার কি টিকে থাকবে?
একদিকে রিপাবলিকান ও সমাজতন্ত্রী উভয়েই সরকারের পতনের হুমকি দিচ্ছে, তবে তাদের দাবি একে অপরের বিপরীত। রিপাবলিকানরা কর বাড়াতে দেবেন না; সমাজতন্ত্রীরা ধনীদের ওপর কর না বাড়ালে অনাস্থা আনবেন।
তাদের এই অবস্থান এক অর্থে ৪৯.৩ ধারারই উল্টো রূপ— এবার সরকার নয়, বিরোধী দল সেটিকে চাপ হিসেবে ব্যবহার করছে।
তবুও, গোপনে কিছু সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সোমবার সরকার নিজ বাজেটে বড় ব্যবসার ওপর “অস্থায়ী সারচার্জ” ৪ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৬ বিলিয়ন ইউরো করেছে— যা সমাজতন্ত্রীদের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
এছাড়া সমাজতন্ত্রীরা তাদের প্রস্তাবিত “জুকম্যান ট্যাক্স” কিছুটা নমনীয় হয়েছে— পরিবার বা নতুন প্রযুক্তি ব্যবসার মালিকানা এতে বাদ পড়বে। সরকার এখনো এর বিরোধিতা করলেও আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে।
সবকিছু এখন নির্ভর করছে ৬৯ জন সমাজতন্ত্রী ও ৫০ জন রিপাবলিকান এমপি’র ওপর। কট্টর বাম ও ডান সবসময়ই বিশৃঙ্খলার পক্ষে। মধ্যপন্থী দুই শিবিরের নেতারা হুমকি দিচ্ছেন— তাদের দাবি না মানলে সরকার পড়বে।
কিন্তু রিপাবলিকানরা বিভক্ত, সমাজতন্ত্রীদেরও দ্বিধা আছে। কারণ তারা যদি লেকর্নু সরকার ফেলে দেন, তবে তা হতে পারে তাদের একটি বড় সাফল্য যদিও ২০২৩ সালের পেনশন সংস্কার স্থগিত রাখার সুযোগ হারাতে পারেন।
বিশ্লেষণ: ফরাসি চিকিৎসকদের মতোই বলা যায়, “সরকারের আয়ু নিয়ে এখন কোনো নিশ্চিত পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।”
তবুও মনে হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে হয়তো কোনো না কোনো সমঝোতা হয়ে যাবে।

















