আবুসাঈদ আনসারী
১লা এপ্রিল ২০২০ হঠাৎ শরীরে প্রচন্ড ঝাঁকুনির সাথে জ্বর উঠলো। কোনো ভাবেই যেন দাঁড়াতে পারছিলাম না। তারপর গলা ব্যথা আর অনবরত কাশি শুরু হলো। শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশীতে আরম্ভ হলো তীব্র ব্যথা। মনে হলো কেউ যেনো আমাকে হাতুড়ি দিয়ে শরীরে আঘাত করছে আর গলায় যেন ছুরি চালাচ্ছে অনবরত। ভাবলাম এই বুঝি করোনার অনিবার্য আগমন হলো! এর কিছু দিন আগেও কাশি ছিল, ভালো হয়ে গিয়েছিলাম তারপর আবার শুরু হলো করোনার তান্ডব। আল্লাহকে ডাকা শুরু করলাম। ৩রা এপ্রিল শুক্রবার আমার শাশুড়ী যিনি আমার বাসার খুব কাছে থাকতেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে চির গন্তব্যে চলে গেলেন। আমার স্ত্রী তীব্র মাতৃশোকে কাতর। এ কদিন তিনি একাই হাসপাতালে ছুটেছেন। প্রথমে তাঁর খুব বুক ব্যথা হয়েছিলো। ডাক্তাররা ভেবেছিলো হার্টের সমস্যা। এর আগে অবশ্য দুবার তাঁর হার্ট এ্যটাক হয়। কিন্তু পরবর্তী টেস্টে ধরা পড়ে কবিড ১৯।
মৃত্যর সময় পরিবারের কাউকে তাঁর সাথে থাকার অনুমতি দেয়নি উয়েসট মিডলসেকস হাসপাতাল। করোনা শনাক্ত করার পর থেকেই তাঁকে আইসোলেইটেড করে ফেলা হয়। বলতে হবে তিনি একা একাই মারা যান। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
সে শুক্রবার রাতে আমার উপসর্গ আরো বেড়ে যায়। ক্রমে ক্রমে আমার ঘ্রান শক্তি লোপ পেয়ে যায়। আমার মনে আছে কুয়েত থেকে আমার ভগ্নিপতির দেয়া অত্যন্ত সুঘ্রাণযুক্ত আতর মেখেও কোনো ঘ্রাণ আমি পাইনি। আমি মনে মনে আল্লাহকে বললাম, ‘হে আল্লাহ পৃথিবীর ঘ্রাণের বদলে আপনি যদি জান্নাতের ঘ্রাণ দিয়ে দেন, তাতে আমি খুশি’!
এর মধ্যে একদিন বিলাতের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে ফোন করলাম, আমার স্ত্রীও কথা বললেন, তাঁরা এম্বুলেন্স পাঠালেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হাসপাতালে যাবো না।
এদিকে আমার সার্জারির ডাক্তার ওয়াটসন এবং ডাক্তার ব্যানার্জি বার বার ফোন করে খবর নিচ্ছিলেন। অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে, এখন তীব্র বুক ব্যথা শুরু হলো। মনে হচ্ছিলেন কেউ যেনো ঠান্ডা বড়ো একটা পাথর বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছে। শ্বাস কষ্টও শুরু হয়ে গেলো।
ডাক্তার ব্যানার্জি একজন অত্যন্ত অমায়িক, মেহেরবান চরিত্রের মহিলা। ভিডিও কল করে আমার খোঁজ নিতে শুরু করলেন। বললেন, ‘Mr Ansarey what can I do for you? You tell me. Would you like to go to the hospital?’ আমার পরিবার অনড় হাসপাতালের না যাবার পক্ষে। কারণ ইতোমধ্যে আমার শাশুড়ীর একা একা মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে দারুন কষ্ট দিয়েছে। ডাক্তার ব্যানার্জিকে বললাম, ‘Do you have any other option?’ উনি বললেন, ‘We have got very limited options, but, we can send you to a community hub clinic?’ আমি সেই অপশনটাই নিলাম।
২২ শে এপ্রিল ২০২০ কমিউনিটি হাব ক্লিনিকে গেলাম। মনে হলো আমি একজন এ্যালিয়েন, ভীনগ্রহ থেকে এইমাত্র পৃথিবীতে এসেছি। ক্লিনিকে ঢুকার পর একজন নার্স পাশের রুম থেকে বললেন আমার পরনের গ্লাভস খুলে ফেলতে এবং হ্যানড স্যানিটাউজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে মাস্ক পরতে বললেন। আমি বললাম, আমার মাস্ক আছে। একা রুমের মধ্যে বসে আছি। বুকে তীব্র ব্যথা।শরীর খুব দূর্বল তখন। মনে হচ্ছিল এই যেনো পড়ে যাই। তারপর ঐ কক্ষ থেকে ডাক আসলো, ঢুকলাম সেখানে। একটু পরে একজন স্প্যানিশ ডাক্তার আসলেন, প্রথমে ২ মিটার দূর থেকে দেখলেন। পিপিই পরা সেই ডাক্তার পরে কাছে আসলেন। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বললেন, ‘তোমার লাং ইনফেকশন হয়ে গেছে’। শ্বাস কষ্ট মনিটরিং করার কথা বললেন। বেশি বাড়লে হাসপাতালের যাবার পরামর্শ দিলেন। অভয় দিলেন এ কথা বলে যে হাসপাতালের চিকিত্সা হচ্ছে। তবে কিছু ভয় ঢুকিয়েও দিলেন। এ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যা বললেন তা হলো, ‘আজকেই দুটো ঔষধ খেয়ে নেবেন, তবে ২৪ ঘন্টা পর যে কি হবে তা বলতে পারবো না।’ আল্লাহর উপর ভরসা করে সেখান থেকে ঘরে ফিরলাম।
অনেক দিন ধরে আইসোলেইশনে আছি।আমার রুমের জানালা খুলে শ্বাসকষ্ট কে লাঘব করার চেষ্টা করি। সবার কাছে দোয়া চাই। কোরআন হাদিসের দোয়া গুলো পড়ি। সর্বক্ষন ইস্তেগফার পড়ি। বিলেতের একটা টেলিভিশনে যেখানে আমি নিয়মিত অনুষ্ঠান করতাম সেখানেও দোয়া চাওয়া হয়। প্রতিটি দিন মনে হতো এই মনে হয় কবরের খুব কাছে চলে এসেছি। গাঢ় অন্ধকার কবর। আমার বাবা লন্ডন থেকে ফোনের মাধ্যমে সব ভাই বোনদের কে নিয়ে দোয়া করেন। আমার অসহায় স্ত্রীও দোয়া করেন। বাচ্ছারাও দোয়া করে।
আমার ছোট্ট মেয়ে নুসাইবাহ কাছে আসতে চাইতো, মাকে বলতো ‘কই আমি তো বাবার মাঝে ভাইরাস দেখি না,’ দূর থেকে ইশারায় আদর আর মায়া দিতো। বাবা হিসেবে আমার খুব কষ্টে বুক ফেটে যেতো।। অনেক দিন বাচছাদেরকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি।
আমেরিকা প্রবাসী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব আমার ভাই মুশফিকুল ফজল আনসারী বর্তমানে যিনি White House এ জাস্ট নিউজ বিডির একজন করেসপন্ডেনট হিসেবে কাজ করছেন তিনি একদিন নিউইয়র্ক এর বিখ্যাত ডাক্তার লুলু কে আমার সাথে ফোনালাপ করিয়ে দিলেন। তাঁর কথা মতো প্রউন পজিশনে শোয়ার ব্যায়াম করলাম। অনেক ভালো ফল পাওয়া গেলো। আসলে ভাইরাসটি চায় ফুসফুসে আঘাত হানতে। সে শরীর কে অত্যন্ত দূর্বল করে inactive করতে চায়। এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যায়ামের প্রয়োজন। যেমন প্রানায়াম, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম। এগুলো করতে থাকলাম।
সেই সময় ব্রিটেনে করোনা মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। হতাশ না হয়ে প্রফেটিক এবং ন্যাচারাল মেডিসিন গ্রহন শুরু করি কালোজিরা, কালোজিরার ভর্তা, তার তেল, মধু, সরিষার তেল,জমজমের পানি, আজোয়া খেজুর , লেবুর সরবত এবং গরম পানির ভাপ। তারপর লবন আর হলদে গুড়া মিশিয়ে গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা। এগুলো নিয়মিতই করতাম। আলহামদুলিললাহ, অনেক ফল পেতে শুরু করলাম।
জ্বর, কাঁশি বেশি দিন ছিলো না। তবে শরীরের ব্যথাটা ছিলো তীব্র আর সাথে ছিলো শ্বাস কষ্টটাও। জানালার পাশে বসে প্রকৃতির সাথে বন্ধন করার চেষ্টা করতাম। বিলেতে ঘুঘু পাখির আনাগোনা কম। কিন্তু সে সময় একটা ঘুঘু পাখি আমাদের জানালার পাশে সারাক্ষন ডাকতো। তার সে ডাক আমাকে কৈশরের দূরন্ত দিনগুলো কে মনে করিয়ে দিতো। শাহী ঈদগাহের পাশের টিলার উপরের ঘুঘু পাখি। অনবরত তার ডাকটা ভীষন ভালো লাগতো বিশেষ করে জ্বরে আক্রান্ত হলে সে সময় আম্মা মাথায় শুধু পানি ঢালতেন। তখন পানি ঢালার শব্দ আর ঘুঘুর ডাক দুটোর কোনোটি বিরক্ত লাগতো না! বরং বেশ ভালো লাগতো। টেমস নদীর পাশে আমাদের ঘর থাকায় বিভিন্ন গাংচিল আর পাখিদের সাথে আমাদের নিত্য বসবাস। বিলেতে এখন বসন্ত কাল। প্রকৃতি নতুন সাজে সেজেছে। বাহারী ফুলে ভরা আমার বাগান থেকে আমার মেয়ে আমার জন্য ফুল নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে রাখতো। ফুলের প্রতি মনে হয় মেয়েদের দূর্বলতা ছেলেদের চেয়ে বেশি!
আমার তিন ছেলে, উমার, উজাইর আর উবাই। সব সময় কেউ না কেউ পানির ফ্লাস্কটা গরম পানি দিয়ে ভরে রাখতো। ঐ সময় গরম পানি ছিলো আমার খাবার। কোনো খাবারে টেস্ট লাগতো না। ডাক্তার বলতো খুব পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
প্রায়ই রাত ৮ টায় বিলেতের মানুষেরা হাসপাতালে কর্মরত স্টাফদের জন্য ঘরের জানালার সামনে এসে হাত তালি দেয়। আমার মেয়ে তা খুব ইনজয় করে। প্রতিবেশির কেউ কেউ থালা-চামচ নিয়ে দু হাতে বাজাচ্ছে… তখন আমার মেয়ের জন্য জানালা ছেড়ে দিতাম। নুসাইবাহ আমাকে খুশি রাখার জন্য ছবি আঁকতো। তার প্রতিটি ছবিতে রংধনু থাকতো। বিশাল রংধনু। নানা রংয়ের রংধনু। মনে হতো ঘন বর্ষনের পরে আকাশে জেগে উঠা রংধনুর মতো একদিন আমি ভালো হয়ে যাবো ইনশাল্লাহ। এ ছবিগুলো আমাকে আশার আলো দেখাতো।
আমার মাকে কোনো সময় আমি বলিনি এ করোনাভাইরাসের আক্রমণের খবর। কিন্তু সব সময় দোয়া চাইতাম। তিনি বলতেন ‘ইনশাল্লাহ ভালো হয়ে যাবে।’ আলহামদুলিললাহ, অবশেষে একদিন একদিন করে অক্সিজেন লেভেল কন্ট্রোলে আসলো। তবে নাকের ঘ্রাণ ফিরে পেতে অনেক সময় লেগেছিলো।
এ্যানটিবায়োটিক পর পর দুবার দিয়েছিলো ডাক্তার। সাইড এফেক্ট ও ছিলো একটু বেশি। মাঝে মাঝে মনে হতো আমার কোনো হাত- পা নেই। তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হতে শুরু করলো। আমি কখনো হতাশ হই নি।বিশ্বাসীর জীবন হচ্ছে আশা আর ভয়ের মধ্যে! ভয় ছিলো কি নিয়ে আমি প্রভুর কাছে উপস্হিত হবো? যদি এই যাত্রায় চলে যাই এই ঘুঘু পাখি আর টেমসের সখ্যতা ছেড়ে। আর আশা ছিলো ইনশাল্লাহ হয়তো ভালো হয়ে যাবো রংধনুর মতো।কাগজে আঁকা কিংবা আকাশের রংধনুর মতো।