এএমসি রোমেল : বাংলাদেশের সমাজে এখন একটি স্পষ্ট ও বাড়তে থাকা প্রবণতা হলো—তরুণদের বিদেশমুখিতা। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাস—যেকোনো সুযোগ পেলে দেশের মেধাবী তরুণেরা এখন বাইরের দিকেই ছুটছেন। এটি নিছক ব্যক্তিগত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা নয়; বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে।
**কেন তরুণরা দেশ ছেড়ে যেতে চাইছেন?**
তা কি কেবল উন্নত জীবনের হাতছানি, না কি দেশের ভেতরে বিদ্যমান কাঠামোগত ব্যর্থতা এ দায়ভার বহন করছে?
বিদেশমুখিতার পেছনের বাস্তবতা
১. **রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতা**
রাজনীতিতে অস্থিরতা, মত প্রকাশে বাধা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অভাব তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়েছে। তারা মনে করেন, দেশজ চিন্তা বা ভিন্নমত প্রকাশ করলেই হয়রানির শিকার হতে হয়।
২. **শিক্ষা ও গবেষণার অপ্রতুলতা**
দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সীমিত। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার এবং দক্ষতার মূল্যায়নের পরিবেশ তরুণদের বিদেশে পড়াশোনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
৩. **চাকরি ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার সংকট**
দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকায় মেধাবীরা মনে করেন, বিদেশে গিয়ে তারা নিজের পেশাগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবেন আরও স্বাধীনভাবে।
৪. **পরিসংখ্যান বলছে উদ্বেগের কথা**
শুধু ২০২৪ সালেই প্রায় **১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী** উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে গিয়েছেন। অনেকেই লক্ষ্য করেছেন স্থায়ীভাবে বিদেশে থেকে যাওয়া।
এই মেধা-পলায়ন কি শুধু সমস্যা?
বিদেশে থাকা অনেক তরুণ সফলতার মুখ দেখেন এবং দেশে পরিবার ও সমাজকে সহায়তা করেন। কেউ কেউ ফিরে এসে দেশের উন্নয়নেও অবদান রাখেন। তবে সব গল্প তেমন নয়।
* অনেকে **”ব্রেইন ড্রেইন”**-এর শিকার হন—দেশ থেকে দূরে থেকেও মেধা দেশের কাজে লাগে না।
* আবার কেউ কেউ বিদেশের সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে না পেরে **মানসিক সংকটের** মুখোমুখি হন।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশকে **দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি**, **নেতৃত্ব সংকট** এবং **অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতার** মুখোমুখি হতে হবে।
সম্ভাব্য সমাধান: দেশেই সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে
তরুণদের বিদেশমুখিতা রোধ করতে হলে **তাদের আশা ও সম্ভাবনার জায়গাগুলো দেশেই সৃষ্টি** করতে হবে। সরকারের জন্য এটি এখন আর বিকল্প নয়, বরং জরুরি দায়িত্ব।
🔹 ১. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন
* **কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সম্প্রসারণ**
* **ইংরেজি ও ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ**
* **সিলেবাস আধুনিকায়ন ও গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত**
🔹 ২. উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তোলা
* **সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান**
* **কর ছাড় ও স্টার্টআপ ইনকিউবেটর প্রোগ্রাম**
* **উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ**
🔹 ৩. টেকসই কর্মসংস্থান
* **ডিজিটাল চাকরি প্ল্যাটফর্ম ও চাকরি মেলা**
* **নতুন শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ**
* **বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রাইভেট-সরকারি অংশীদারিত্ব**
🔹 ৪. কাজের পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা
* **ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ**
* **নারী কর্মীদের জন্য বিশেষ সুযোগ**
* **স্বাস্থ্যবীমা ও সুরক্ষা নীতিমালা**
🔹 ৫. তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে উৎসাহ
* **গ্রামীণ ডিজিটাল শিক্ষা প্রসার**
* **হ্যাকাথন, আইটি প্রশিক্ষণ, ও স্টার্টআপ প্রতিযোগিতা**
* **গবেষণা ও উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ**
🔹 ৬. প্রশাসনিক সরলীকরণ
* **ব্যবসা ও চাকরির অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা**
* **তারুণ্যবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন**
🔹 ৭. প্রবাসী মেধার পুনঃবিনিয়োগ
* **বিদেশে দক্ষতা অর্জিত তরুণদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ**
* **রিহায়ারিং ও রিইন্টিগ্রেশন স্কিম চালু করা**
শেষ কথা: দেশ গড়তে হলে তরুণদের দেশেই রাখতে হবে
যদি দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা বিদেশে থেকেই যান, তবে প্রশ্ন উঠে—**দেশ স্বাবলম্বী হবে কিভাবে?**
এর উত্তর আমাদের সবাইকেই খুঁজে বের করতে হবে, একসঙ্গে।
তরুণদের দোষারোপ না করে, তাদের জন্য **আশার জায়গা তৈরি করলেই** তারা দেশেই থাকতে আগ্রহী হবে। কারণ, **তরুণেরা দেশ ছাড়ে না—তারা সম্ভাবনার খোঁজে যায়।** সেই সম্ভাবনাটা যদি আমরা দেশেই তৈরি করতে পারি, তবে ভবিষ্যৎ আর বিদেশে নয়, এখানেই গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশের প্রায় **৪৫% মানুষ তরুণ (১৫–৩৫ বছর)**—এটাই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই জনশক্তিকে দক্ষতা, শিক্ষা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে কাজে লাগানো না গেলে তা হবে এক **অপূরণীয় ক্ষতি**।
সরকার, বেসরকারি খাত, এবং সমাজ—সব পক্ষকেই একযোগে কাজ করতে হবে। তরুণদের শুধু সস্তা শ্রমিক নয়, বরং **জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কারিগর** হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক